আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় আতপ চাল দিয়ে বিভিন্ন পিঠা তৈরি
Table of Contents
আতপ চাল দিয়ে বিভিন্ন পিঠা তৈরি
আতপ চাল দিয়ে বিভিন্ন পিঠা তৈরি
বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে পিঠা একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। পিঠা নিজেরা খেয়ে যত না তৃপ্তি পাওয়া যায় তার চেয়ে বেশি আনন্দ পাওয়া যায় অতিথি আপ্যায়নে। বাংলাদেশে শীতকালের সঙ্গে শীতের পিঠার সম্পর্ক গভীর ও অনেক পুরোনোও। শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় শীতের পিঠা বানাবার আয়োজন। গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত এই পিঠা বানানো এং খাওয়ানো চলে সমান তালে।
শীতের পিঠার রকম যেমন অনেক, তেমটি খাওয়ার স্বাদও বিভিন্ন। শীতকাল ছাড়াও পহেলা বৈশাখে, নববর্ষে, বিবাহ অনুষ্ঠানে পূজা ও ঈদ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন পিঠার ব্যবহার দেখা যায়। বর্তমানে দ্রব্যমূল্যে উর্ধ্বাগতি ও কাজের ব্যস্ততায় গৃহিণীদের নিজ হাতে পিঠা তৈরি আর হয়ে ওঠে না। আজকাল শহরে শীতকালে ও নববর্ষের বৈশাখী অনুষ্ঠানে পিঠামেলা অনুষ্ঠিত হয়।
পিঠা তৈরিতে সাধারণত চাল, গুড়, আটা বা ময়দা, তেল বা ঘি, এলাচ, কিসমিস, বাদাম, পেস্তা, সুজি, ক্ষীর, খিরসা, কলাই ডাল, ছোলার ডাল, মুগের ডাল, দুধ ও চিনির প্রয়োজন হয়। বিভিন্ন প্রকার পিঠাগুলো হচ্ছে- পাটিসাপটা, চিতই পিঠা, ভাপা পিঠা, দুধপুলি, মুগ পাকন, চন্দ্রপুলি, তালের পিঠা, দুধ চিতই, নকশি পিঠা, কলার পিঠা, দই মালপোয়া, পাতা পিঠা, কাটা পিঠা, তেল ভাজা পিঠা ইত্যাদি ।
পাটিসাপটা :
এই পিঠা তৈরিতে হাতে করা আতপ চালের গুঁড়ি, বেকিং পাউডার, চিনি বা গুড়, দুধ, খিরসা বা ক্ষীর, ছোট এলাচ, তেল বা ঘি, পরিমানমতো নিতে হয়। দুই কাপ পানিতে চালের গুঁড়ি, বেকিং পাউডার, গুড় বা চিনি, দুধ মিশিয়ে গোলা তৈরি করে এক থেকে দেড় ঘণ্টা ঢেকে রেখে দিতে হয়। এবার খিরসা বা ক্ষীর চটকিয়ে চিনি ও এলাচগুঁড়ো মিশিয়ে নিতে হয়। হাঁড়িতে দুই চামচ ঘি গরম করে ঢেলে ভালো করে নাড়াচাড়া করে নামাতে হয়।
চিত্র : পাটি সাপটা পিঠা
এবার পাত্র গরম করে কিছু তেল দিয়ে সারা পাত্র চামচ বা ন্যাকড়া দিয়ে মেখে নিতে হয়। এখন অল্প আঁচে বড় চামচের ১ চামচ গোলা দিয়ে পাতলা করে রুটির মতো সম্পূর্ণ পাত্রে ছড়িয়ে দিতে হয়। গোলার উপরিভাগ শুকিয়ে এলে রুটির এক পাশ পরিমাণমতো ক্ষীরের পুর লম্বা করে দিয়ে ডিমের ওমলেটের মতো মুড়ে সামান্য ভেজে তুলতে হয়।
এমনি করে প্রতিবার গোলা দেওয়ার পূর্বে পাত্রে ন্যাকড়া দ্বারা তেল মেখে নিয়ে আরও কয়েকটি পাটিসাপটা পিঠা বানায়ে ভেজে তুলতে হয়। ঠাণ্ডা হলে পরিবেশন করতে হয়। পিঠার মাঝে পুর হিসেবে মাখা সন্দেশ বা পাটালি গুড় জ্বাল দেওয়া নারিকেলের কোরা ব্যবহার করা যায়।
দুধ গুলি :
এই পিঠা তৈরিতে আতপ চালের গুঁড়ি, দুধ, চিনি, নারিকেল কোরা, খিরসা বা কনডেন্সড মিল্ক, তেল, এলাচ গুঁড়ো পরিমাণমতো নিতে হয়। প্রথমে একটি পানিশূন্য হাঁড়িতে নারিকেলের কোৱা, চিনি, দুধের ক্ষীরসা বা কনডেন্সড মিল্ক মিলারে জ্বাল দিয়ে পুলি পিঠার পুর তৈরি করে রাখতে হয়। এরপর একটি হাঁড়িতে আধা লিটার পানি ফুটাতে হবে।
চিত্র: সুখ পুলি পিঠা
পানি ভাল করে ফুটে গেলে এতে চালের গুঁড়ি, লবণ ও সামান্য তেল দিয়ে সিদ্ধ করে নামাতে হয়। একটু ঠাণ্ডা হলে আটা মাখার মতো করে রুটি তৈরির মত বা খামির তৈরি করতে হয়। রুটির ভিতরে নারিকেল দুধের পুর অল্প অল্প করে স্তরে পিঠার মুখ সুন্দর করে মুড়ে দিয়ে বন্ধ করে দিতে হয়। এর আকৃতি হবে অর্ধচন্দ্রাকার। পাত্রে তেল গরম করে হালকা আঁচে বাদামি রং করে গুলি ভেজে নিতে হয়।
এবার একটি হাঁড়িতে দুধ, গুড় বা চিনি, এলাচ ও দারুচিনি একত্রে জ্বাল দিতে হয়। কিছুটা ঘন হয়ে এলে এতে পুলিগুলো একটি একটি করে ছাড়তে হয়। খুব সাবধানে খুক্তি দিয়ে নাড়তে হবে যাতে ভেঙে বা লেগে না যায়। দশ-পনেরো মিনিট চুলায় হালকা আঁচে রেখে নামাতে হয়। এ পিঠা গরম অথবা ঠান্ডা দুই ভাবেই খাওয়া যায়, তবে ঠাণ্ডা পিঠাই বেশি মুখরোচক।
চিতই পিঠা :
এ পিঠা তৈরিতে আতপ চাল, খেজুরের গুড় বা নারিকেল কোরা, পিঠা তৈরির বিশেষ ধরনের সরা বা সাজু, বেগুনের বোঁটা বা ন্যাকড়া, সরিষার তেল ইত্যাদি প্রয়োজন হয়। প্রয়োজনমতো পানি দিয়ে চালের গুঁড়ো গুলিয়ে ঘন করে গোলা তৈরি করে নিতে হয়। এখন পিঠা তৈরির বিশেষ ধরনের সরা ধুয়ে-মুছে চুলায় বসাতে হবে। এই সরায় ছোট ছোট অনেক গর্ত থাকে।
পিঠা ভাজার এই সরাকে তাওরাও বলে। প্রত্যেকটি পর্বে একটি করে পিঠা ভাজা যায়। এখন সরার সকল গর্তে বেগুনের বোঁটা বা ন্যাকড়া দিয়ে সরিষার তেল মাখিয়ে নিতে হয়। এরপর চালের গোলা সরার সকল বাটিতে করে আঁচ কমিয়ে রেখে অন্য একটি সরা দিয়ে ঢেকে দিতে হয়। মিনিট পাঁচেক পর সরার ঢাকনা খুলে দেখা যাবে যে পিঠাগুলোর উপরের দিকের গোলা সিদ্ধ হয়ে ফুলে ওঠে।
তখন খুঁজি দিয়ে আছে পিঠা তুলে নিতে হয়। যদি গোলা ঠিকমতো শুকারে পিঠা তৈরি হয়ে থাকে তবে চামচ বা খুন্তি দিয়ে পালে আলতো করে চাপ দিলে পিঠা উঠে আসে। পিঠা তুলে পুনরায় ম্যাকড়ার কাপড়ে তেল লাগিয়ে উক্ত সাজ বা সরার খাঁজ মুছে গোলা দিতে হয়। এইভাবে পর পর পিঠা বানাতে হয়। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন সবগুলো পিঠা বানানো না হওয়া পর্যন্ত চুলা থেকে সাজ নামানো না হয় ।
তৈরি পিঠা নারিকেল কোরা ও ঝোল গুড় সহযোগে পরিবেশন করা হয়। এ পিঠা জ্বাল দেয়া ঘন খেজুরের রস ও দুধের মিশ্রণে সারারাত ভিজিয়ে শীতের সকালে পরিবেশন করলে খুবই সুস্বাদু লাগে। চিতই পিঠাকে অনেকে সাজের পিঠাও বলে।
চিত্র : সরা বা সাচ্ছে চিতই পিঠা ভাজা হচ্ছে
ভাপা পিঠা:
চালের গুঁড়ি, পাটালি গুড়, লবণ, নারিকেল কোৱা, দুধ বা পানি সহযোগে এ পিঠা বানানো যায়। চালের উড়ির সাথে অল্প দুধ বা পানি ভালো করে মিশিয়ে চালনিতে চেলে নিতে হয়। হাঁড়িতে চার ভাগের তিন ভাগ পানি নিয়ে চুলার চড়াতে হয়। হাঁড়ির মুখ ঢাকনা বা সরা দিয়ে ঢেকে দিতে হয়।
চিত্র : ভাপা পিঠা
ঢাকনার ঠিক মাঝখানে একটি ছিদ্র রেখে চারদিকে আটা বা ময়দা গুলে লগিয়ে দিতে হয় যাতে করে হাঁড়ির ৰাষ্প চতুদিক দিয়ে বের না হয়ে শুধু ছিদ্রপথে বের হয়। ছোট বাটি বা নারিকেলের আইচার মধ্যে অর্ধেক চালের গুঁড়ি নিয়ে তারপর অল্প নারিকেলের কোরা ও খেজুরের গুড়ের টুকরা দিয়ে পুনরায় চালের গুঁড়ি দিয়ে বাটি ভরতে হয়।
পাতলা ভিজা কাপড় দিয়ে পিঠার বাটি ঢেকে ঢাকনার ঠিক মাঝখানে ছিদ্রপথের উপর উল্টো করে বসাতে হয়। সতর্কতার সাথে বাটিটা এমনভাবে তুলে আনতে হয় যাতে পিঠা ভেঙে না যায়। পরে পাতলা কাপড় দিয়ে পিঠা ঢেকে দিতে হয়। তারপর একটি বড় ঢাকনা বা সরা দিয় সম্পূর্ণটা ঢেকে দিতে হয়। মিনিট পাঁচেক পর পিঠা সিদ্ধ হলে ন্যকড়াসহ তুলে আনতে হয়।
পিঠা সিদ্ধ হয়েছে কিনা হাতের আঙ্গুল দিয়ে পিঠার উপরি ভাগে চাপ দিয়ে পরীক্ষা করা যাবে। এভাবে পিঠা তৈরি করে ট্রেতে সাজিয়ে পরম অবস্থায় খেতে হয়। এক সাথে অনেকগুলো পিঠা তৈরির জন্য বড় হাঁড়ি ও অনেকগুলো ছিদ্রযুক্ত বড় সরা বা ঢাকনা ব্যবহার করা যায়।
ভাপা পিঠার মধ্যে বৈচিত্র্য আনতে নারিকেল কোরা আর গুড়ের পরিবর্তে পনির কুচি, চিংড়ি মাছের কুঁচো বা পোন্তের কিমাও দেয়া যেতে পারে। তবে এই পিঠা বানানোর সময় খেয়াল রাখতে হবে যাতে পিঠার দুই দিকের স্তর অতিরিক্ত পুরু না হয়।
ভাজা পিঠা :
চালের গুঁড়ি, মুগডাল, লবণ, হলুদ গুঁড়ো, আদাকুচি, জিরা গুঁড়ো, মরিচ গুঁড়ো, নারিকেল কোরা, চিনি, সরিষার তেল, শুকনা মরিচ ইত্যাদি এই পিঠা তৈরিতে লাগে। প্রথমে ডাল ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিতে হয়। কড়াই চুলায় চড়িয়ে নারিকেল কোরা ও চিনি একসঙ্গে মেখে কড়াইতে দিয়ে খুন্তি দিয়ে নেড়েচেড়ে নারিকেলের পুর তৈরি করে পাত্রে ঢেলে রাখতে হয়।
কড়াই ধুয়ে আবার চুলায় চাপায়ে সামান্য তেল ঢালতে হয়। তেল গরম হলে তেজপাতা, শুকনো মরিচ ও জিরা ফোড়ন দিয়ে জ্বাল দিতে হয়। খুন্তি দিয়ে নাড়াচাড়া করে ডাল ভেজে প্রেসার কুকারে দিতে হয়। দুকাপ পানি, লবণ, হলুদ, আদা কুচি, জিরে গুঁড়ো, মরিচ গুঁড়ো, কুকারে ডালের সঙ্গে দিয়ে কুকারের মুখ বন্ধ করতে হয়।
দুইবার বাঁশি দিলে চুলা থেকে নামায়ে ঠাণ্ডা করে ঢাকনা খুলে দিতে হয়। এবার ডাল কড়াইতে নিয়ে জ্বাল দিলে ফুটতে শুরু করলে তা চালের গুড়িতে ঢেলে দিতে হয়। সিদ্ধডাল ও চালের গুড়ি ভালোমতো মেখে ময়ান দিয়ে খামির তৈরি করতে হয়। খামির থেকে ছোট ছোট বল নিয়ে রুটি করে। রুটির ভিতর অল্প অল্প করে নারিকেলের পুর ভরে গোলাকার পুলি তৈরি করে মুখ হাত দিয়ে
চিত্র : ভাজা পিঠা
টিপে বন্ধ করতে হবে। অবশ্যই পুলিগুলো ছোট ছোট আকারের থেকে হয়। এবার কড়াইতে আরও তেল দিয়ে চুলায় চেপে পুলিগুলো বাদামি করে ভেজে নিতে হয়।
আরও দেখুন :