আজকে আমরা খাদ্যের কাজ সম্পর্কে আলোচনা করবো । যা খাদ্য রসায়নের মৌলিক ধারণা অধ্যায়ের অর্ন্তভুক্ত।
Table of Contents
খাদ্যের কাজ । Functions of Food
দেহে কাজের ধরন অনুসারে খাদ্যকে নিম্নরূপ চারটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছে। যেমন
(১) পুষ্টিসাধক, ক্ষয়পূরক ও বৃদ্ধি সহায়ক খাদ্য,
(২) তাপশক্তি উৎপাদক খাদ্য,
(৩) দেহের অভ্যন্তরীণ ক্রিয়া পরিচালনাকারী ছানা এবং
(৪) দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গঠনকারী খাদ্য।
নিম্নে এ চার ধরনের খাদ্যের কাজ বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-
১। পুষ্টিসাধক, ক্ষয়পূরক ও বৃদ্ধি সহায়ক খাদ্য :
প্রোটিনের মূল উপাদান অ্যামাইনো এসিড জীবদেহের প্রোটোপ্লাজম গঠনের দ্বারা বৃদ্ধি সাধন করে, ক্ষয়পূরণ করে। উপযুক্ত পরিমাণ অ্যামাইনো এসিডের অভাবে দেহ রুপু ও অপুষ্ট হয়ে পড়ে। দেহ গঠনে কিছু খনিজ পদার্থ অগ্রণী ভূমিকা নেয়। তাই যে সমস্ত খাদ্যে প্রোটিন ও খনিজ পদার্থ উপযুক্ত অনুপাতে থাকে, তাদের বৃদ্ধিসহায়ক, ক্ষয়পূরক ও পুষ্টিসাধক খাদ্য বলে।
২। তাপশক্তি উৎপাদক খাদ্য :
প্রত্যেক জীবদেহে অনবরত নানা প্রকার জীবন ক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে। এই জীব ক্রিয়াগুলি সম্পন্ন হওয়ার জন্য শক্তির প্রয়োজন। প্রাণিদেহে এই শক্তির প্রধান উৎস হল খানা। খাদ্যের এই শক্তি প্রধানত স্থিতিশক্তি (যা সৌরশক্তির রূপান্তর মাত্র) রূপে বর্তমান ।
দেহকোষে এই শক্তি বিশেষ প্রক্রিয়ায় তাপশক্তি বা গতিশক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে জীবদেহের জীবজ ক্রিয়াগুলি নিয়ন্ত্রণ করে। সুতরাং শক্তি অর্জনের জন্য প্রত্যেক জীবকেই খাদ্যগ্রহণ করতে হয়। অন্যান্য জীবের মত মানুষও তার নিজের পরিবেশ থেকে প্রয়োজনমত ও পরিমাণমত খাদ্যগ্রহণ করে। এই খাদ্য পরিপাক ও শোষণের পর আমাদের দৈহিক প্রোটোপ্লাজমের অন্তর্ভূক্ত হয় এবং বিপাকের ফলে তাপশক্তি উৎপাদন করে।
উৎপাদিত তাপশক্তি আমাদের যাবতীয় শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে এবং আমাদেরকে বিভিন্ন ধরনের কাজ করার শক্তি জোগায়। দেহে খাদ্যের ঘাটতি হলে, শরীর ধীরে ধীরে দুর্বল হয়। আমরা কাজ করার শক্তি হারিয়ে ফেলি। এভাবে বেশি দিন চললে শরীরের ক্ষয় হয়। ধীরে ধীরে দৈহিক ওজনও কমে যায়। বিভিন্ন ধরনের রোগ-ব্যাধিও দেহে প্রভাব বিস্তার করে।
৩। দেহের অভ্যন্তরীণ ক্রিয়া পরিচালনাকারী খাদ্য :
খাদ্য দৈহিক পুষ্টি ও বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খালা আমাদের দেহে গৃহীত হওয়ার পর পৌষ্টিকনালীর বিভিন্ন অংশে উৎসেচকের বা এনজাইমের ক্রিয়ায় সরল ও তরল হয়ে প্রোটোপ্লাজমে অঙ্গীভূত হয় এবং এর ফলে দেহের পুষ্টি ঘটে ।
পুষ্টি হল খাদ্যগ্রহণ, পরিপাক, শোষণ, আত্তীকরণ ও বহিষ্করণের দ্বারা দেহের বৃদ্ধি ঘটানো, ক্ষয়-ক্ষতি পূরণ করা এবং স্থিতিশক্তি উৎপাদনে অংশ নেওয়া। পুষ্টি সেই অর্থে একটি উপচিতিমূলক ক্রিয়া। তাছাড়া শিশু জন্মের পর থেকে প্রায় চব্বিশ-পঁচিশ বছর ধরে বাড়তে থাকে। ওই সময় তার বৃদ্ধির জন্য কার্বোহাইড্রেট ও ফ্যাট জাতীয় খানা অপেক্ষা বেশি করে প্রয়োজন হয় প্রোটিন ও বিভিন্ন ধরনের খনিজ পদার্থের।
জীবদেহের ভৌত ভিত্তি হল প্রোটোপ্লাজম। আর প্রোটোপ্লাজম গঠনের জন্য প্রোটিন খাদ্য অপরিহার্য। তাছাড়া দেহের অস্থির বৃদ্ধির জন্য ফসফরাস ও ক্যালসিয়াম জাতীয় খনিজ লবণ বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়। এদের অভাবে শিশুদের অস্থি বিকৃতি বা রিকেট রোগ হয়। এক্ষেত্রে ভিটামিন ‘ডি’ সমৃদ্ধ খাদ্যও বিশেষ ভূমিকা পালন করে। মূলত উপযুক্ত খাদ্যের অভাবে মানবদেহের পুষ্টি ও বৃদ্ধি ব্যাহত হয় ।
৪। দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গঠনকারী খাদ্য :
দেহের পুষ্টি, বৃদ্ধি এবং তাপশক্তি উৎপাদন ছাড়াও খাদ্যের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, তা হলো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলা। খাদ্যের প্রধান ছয়টি বিভাগের মধ্যে ভিটামিন নামক ক্যালরিবিহীন খাদ্য মূলত রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভিটামিন এ’ রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করে। ভিটামিন ‘বি’ বেরিবেরি রোগ প্রতিরোধ করে।
ভিটামিন ‘সি’ স্কার্ভি, ভিটামিন ‘ডি’ অস্টিওম্যালেসিয়া (বড়দের) এবং রিকেট (শিশুদের) রোগ প্রতিরোধ করে । এমনিভাবে বহু ভিটামিন আমাদের দেহে বিভিন্ন ধরনের রোগ-ব্যাধি ঘটতে দেয় না। উল্টোভাবে বললে ভিটামিনের অভাবে আমরা বিভিন্ন রোগ-ব্যাধির শিকার হই। রোগ-ব্যাধির ফলে শরীর দুর্বল হয় এবং আমরা প্রা শক্তিহীন হয়ে পড়ি। এইসব দিক থেকে বলা যায়- দেহের সুস্থতা, সবলতা এবং স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা বলার রাখার পেছনে বিভিন্ন ধরনের খাদ্যের ভূমিকা বর্তমান।
তাপশক্তি উৎপাদন, পুষ্টি-বৃদ্ধির নিয়ন্ত্রণ এবং রোগ প্রতিরোধ ছাড়াও খাদ্যের আরও অনেক কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয়। মানবদেহে প্রতিনিয়ত যে বিপাক ক্রিয়া চলে অর্থাৎ উপচিতিমূলক এবং অপচিতিমূলক ক্রিয়া চলে এগুলির নিয়ন্ত্রণে খাদ্যের বিশেষ ভূমিকা থাকে ।
নার্ভতন্ত্রে ক্রিয়া থেকে শুরু করে উপযুক্ত পরিমাণ হরমোন উৎপাদন, প্রজনন থেকে শুরু করে কোষ বিভাজন রেচন, ক্ষরণ সংবহন যাবতীয় শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য খাদ্যের প্রয়োজন হয়। তাছাড় খাদ্যের গুণগত মান যদি সঠিক না হয়, তাহলে বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়া সঠিকভাবে ঘটতে পারে না। আর তার ফলস্বরূপে দেহে বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়। যেমন ভালো ঘুম হয় না, হৃদযন্ত্রের গতিতে অস্বাভাবিকতা লক্ষ করা যায়, অনেক সময় মাথা ঘোরে, পেটে ব্যথা যন্ত্রণা ইত্যাদি অনুভূত হয়।
শ্বাসক্রিয়ার হারেও অস্বাভাবিকত লক্ষ্য করা যায়। সন্তানসম্ভবা নারীদেহে উপযুক্ত পরিমাণ খাদ্য সরবরাহ করা না হলে, তিন-চার মাসের মধ্যে ওই নারীর স্বাস্থ্য ভাঙতে থাকে। এর থেকে দেহের মধ্যে বাড়তে থাকা ভ্রূণেরও ক্ষতি হতে দেখা যায়। তাই বলা যায় শারীরবৃত্তীয় কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণে খাদ্যের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
আরও দেখুনঃ