আয়রনের প্রাণরাসায়নিক কাজ

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় আয়রনের প্রাণরাসায়নিক কাজ , যা খনিজ পদার্থ অধ্যায় এর অন্তর্ভুক্ত।

আয়রনের প্রাণরাসায়নিক কাজ

যকৃত, ডিমের কুসুম, মাছ, মাংস, সয়াবিন, বাদাম, মটর, মসুর ডাল, পালং শাক, ডুমুর, খেজুর প্রভৃতি লৌহের প্রধান উৎস। সমস্ত অণুপৌষ্টিক উপাদানের মধ্যে লৌহ সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। পুরুষদের অপেক্ষা বাড়ন্ত বাচ্চা ও মহিলাদের লৌহের চাহিদা বেশি।

বাড়ন্ত বাচ্চাদের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রক্তের পরিমাণ বাড়ে আর মহিলাদের ঋতুস্রাবে নির্গত রক্তে হিমোগ্লোবিন নির্গত হয় ও গর্ভবর্তী নারীর দেহে ভ্রুণ বৃদ্ধিতে লৌহ প্রয়োজন হয়।

 

আয়রনের প্রাণরাসায়নিক কাজ

 

মহিলাদের ক্ষেত্রে 40gm এবং বাড়ন্ত শিশুদের 20-25 gm দৈনিক লোহার প্রয়োজন। গৃহীত লোহা তামার (Cu) সাহায্যে শারীরবৃত্তীয় কাজে অংশগ্রহণ করে। দেখা গেছে, প্রতি 24 gm লোহার জন্য 4 gm তামা প্রয়োজন হয়।

প্রাপ্তবয়স্ক মানবদেহে মোট প্রায় 5 গ্রাম লৌহ বর্তমান। এর প্রায় – লৌহ-পরফাইরিন যৌগরূপে নানা অণুতে থাকে। মোট লৌহের প্রায় 65% হিমোগ্লোবিন, প্রায় 5% মায়োগ্লোবিনে এবং প্রায় 0.2% হিম এনজাইমগুলোতে বর্তমান।

হিমোগ্লোবিন অণুতে চারটি ফেরাস আয়নের আকারে লৌহ থাকে। মোট লৌহের অবশিষ্ট + অংশ হিম-ইতর-লৌহ (non-heme iron or NHI) রূপে বিভিন্ন প্রোটিন-যৌগে থাকে।

যেমন- দেহের প্রায় 15-20% লৌহ ফেরিটিন (Ferritin), হিমোসাইডেরিন (hemosiderin) প্রভৃতি লৌহ প্রোটিন যৌগের আকারে প্রধানতঃ যকৃতে এবং কিছু পরিমাণে প্লীহা (spleen), মজ্জা (bone marrow) ও ক্ষুদ্রান্ত্রের গাত্রে সঞ্চিত থাকে।

ফেরিটিন অণুতে ফেরিক হাইড্রক্সাইড ও ফেরিক ফসফেট দিয়ে গঠিত কণা বা মিসেল (micelle) অ্যাপোফেরটিন নামক পানি দ্রাব্য প্রোটিনের সাথে যুক্ত থাকে।

হিমোসাইডেরিন ফেরিক হাইড্রক্সাইড কণার সাথে প্রোটিনের মিলনে গঠিত বৃহৎ অণু অদ্রাব্য লৌহ প্রোটিন যৌগ অথবা লৌহ-চিলেট (iron-chelate) সাইটোপ্লাজমে দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে। একে লৌহ বাহক ভাণ্ডার (Carrier iron pool) বলে।

 

আয়রনের প্রাণরাসায়নিক কাজ

 

হিমোগ্লোবিন অণুর হিম অংশ লৌহ ও পরফাইরিন নামক রঞ্জকের (pigment) মিলনে গঠিত। এজন্য লোহিত রক্তকণিকার উৎপাদন ও হিমোগ্লোবিন সংশ্লেষণের জন্য লৌহ অপরিহার্য। মানবদেহে লৌহের বা আয়নের প্রাণরাসায়নিক কানাগুলো নিম্নরূপ-

মানব-রক্তে হিমোগ্লোবিন গঠনে লোহা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হিমোগ্লোবিনের হিম লৌহযুক্ত পরফাইরিন অণু । এ অণুর কেন্দ্রে একটি লৌহ অণু থাকে। এক অণু হিমোগ্লোবিন গঠনে ও পরমাণু লোহা থাকে।

২। লৌহ আমাদের দেহে জারণমূলক কাজে অংশ নেয় এবং খাদ্যকণার জারণে প্রোটোপ্লাজমে অন্তর্ভুক্ত করে।

৩। সাইটোক্রোম, ক্যাটালেজ, গেরক্সিডেজ ইত্যাদি উৎসেচক গঠন করতে লোহা অংশগ্রহণ করে। এ সকল উৎসেচক

কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট ও প্রোটিনের জারণ ঘটিয়ে শক্তি মুক্ত করে।

৪। মাংসপেশিতে থাকা মায়োগ্লোবিন গঠনে লৌহকণা প্রয়োজন। মায়োগ্লোবিন অক্সিজেনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পেশি-সংকোচন ও প্রসারণে অংশ নেয়।

৫। লোহা থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ করে দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে অংশ নেয়।

৬। লোহা মস্তিষ্কের গঠন এবং মানসিক ও চেষ্টায় বিকাশে অংশ নেয়।

৭। গ্রুপ গঠনে ও মায়ের শরীর রক্ষার্থে লোহা অত্যন্ত প্রয়োজন।

৮। লোহা দেহের অবসন্নতা, দৈহিক দুর্বলতা দূর করে। পরোক্ষে হরমোন উৎপাদন, নিউরোট্রান্সমিটারের অর্থ নিয়ন্ত্রণ এবং সিসা, ক্যাডমিয়াম শোষণে বাধা দিয়ে শারীরবৃত্তীয় কাজ চালনা করে।

 

আয়রনের প্রাণরাসায়নিক কাজ

 

৯। প্রাণিদেহে হিমোগ্লোবিনের মতোই অন্য কয়েকটি শ্বসন-সহায়ক রঞ্জক বা শ্বাসরঞ্জক (respiratory pigment) অণুও হিম নামক লৌহ-পরফিরিন যৌগের সাথে ভিন্ন ভিন্ন প্রোটিনের মিলনে সৃষ্ট হয়। যেমন- পেশিতে অক্সিজেন সঞ্চয়কারী মায়োগ্লোবিন এবং জীবিত প্রাণিকোষের শ্বসন সহায়ক রঞ্জক সাইটোক্রোম ।।

১০। ক্যাটালেজ, পার-অক্সিডেজ, নাইটোক্রোম অক্সিডেজ প্রভৃতি বহু শ্বসন সহায়ক (respiratory) এনজাইমের অণু হিম নামক লৌহ-পরফিরিন যৌগ ও ভিন্ন ভিন্ন প্রোটিনের মিলনে গঠিত। এদের হিম এনজাইম বলে।

১১। কয়েকটি পরফিরিনবিহীন শ্বসন-সহায়ক এনজাইমের অণুতেও লৌহ বর্তমান। ঐ সকল যৌগের লৌহকে হিম-বিরহিত বা

হিম-ইতর-লৌহ (Non-heme iron) বলে। যেমন- মাইটোকন্ড্রিয়ায় NADH ডিহাইড্রোজেনেজ এবং আলফা-গ্লিসেরোফসফেট ডিহাইড্রোজেনেজ এনজাইমের অণুর প্রোটিনেতর (Prosthetic) গ্রুপ লৌহ ও রিবোফ্ল্যাভিন-ঘটিত যৌগের মিলনে গঠিত।

অ্যাড্রেনাল কর্টেক্সের মাইক্রোজোমে বর্তমান ইলেকট্রন-বাহক অ্যাড্রেনোডক্সিনের অণুর প্রোটিনেতর গ্রুপ লৌহ-গন্ধক যৌগের দ্বারা গঠিত।

উপরোক্ত নানাপ্রকার লৌহ-ঘটিত যৌগ প্রাণিদেহে অক্সিজেন পরিবহনে, কোষমধ্যে অক্সিজেন সঞ্চয়ে এবং নানা বস্তুর জারণের

(Oxidation) সময়ে তাদের অণু হতে অপসৃত ইলেকট্রনকে বহন করে আণবিক অক্সিজেন যুক্ত করতে সাহায্য করে।

 

আরও পড়ূনঃ

Leave a Comment