ডাবের পুষ্টিমান

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় ডাবের পুষ্টিমান। ডাব যখন পরিপক্ব হয়, তখন নারিকেলে রূপান্তর হয়। তার আগ পর্যন্ত ডাব বলা যায়। ডাবের পানির পুষ্টিগুণ ও কার্যকারিতা অনেক বেশি। ভৌগোলিকভাবে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলো এবং ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে ডাবের পানির চাহিদা রয়েছে। পুষ্টির গুণাগুণ বিচারে ডাবের ১০০ গ্রাম পানিতে রয়েছে ১৬.৭ ক্যালোরি তথা ৭০ কিলো জুল খাদ্যশক্তি।

ডাবের পুষ্টিমান

 

ডাবের পুষ্টিমান

প্রতি ১০০ গ্রাম ডাবের পানিতে জলীয় অংশ ৯৫ গ্রাম, মোট খনিজ পদার্থ ০.৩ গ্রাম, আমিষ ২.৩ গ্রাম, শর্করা ২.৪ গ্রাম, চর্বি ০.১ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১৫ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ০.০১ মিলিগ্রাম, আয়রন ০.১ মিলিগ্রাম, ০.১১ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি ১, ০.০২ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি২, ৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি ও খাদ্যশক্তি ২৩ কিলোক্যালরি থাকে।

 

ডাবের পুষ্টিমান

ঝুকা বা ঝুনা নারিকেলের মোট ওজনের ৩৫% খোসা, ১২% মালা বা খোলে ২৮% শাঁস ও ২৫% পানি। পরাগায়নের ৪ মাস বয়স পর্যন্ত ডাবে কোনো শাঁস হয় না। এ সময়েই ডাব খাওয়ার উপযুক্ত সময়। ডাবের পানি একটি উৎকৃষ্ট পানীয়। কচি ডাবের পানিতে চিনির পরিমাণ কম থাকে। ধীরে ধীরে শাঁস গঠন শুরু হলে চিনির পরিমাণ বাড়তে থাকে। ৭-৮ মাস বয়সের সময় পানিতে চিনি থাকায় তখন তা মিষ্টি লাগে।

ডাবের পানিতে খাদ্য উপাদান তেমন না থাকলেও খনিজ লবণ যথেষ্ট পরিমাণে থাকে । ডায়রিয়া, কলেরা বা আমাশয়ের কারণে শরীরে পানি শূন্যতা ডাবের পানি দেখা দিলে কচি ডাবের পানি পানে তা পূরণ হয় এবং শরীরে খনিজ লবণের সাম্যাবস্থা ফিরে আসে।

 

ডাবের পুষ্টিমান

 

সাময়িক ক্লান্তি দূরীকরণে কচি ডাবের পানি ও শাঁস দুটোই সমান উপকারি। কচি ডাবের নরম মালায় পর্যাপ্ত পরিমাণ আয়োডিন থাকে ।

পাকা নারিকেলের শাঁস ও ডাবের পানিতে পুষ্টির প্রধান কয়েকটি উপাদানের পরিমাণ দেওয়া হলো। (১০০ গ্রাম খাবার উপযোগী খাদ্যে)

 

ডাবের পুষ্টিমান

 

শাঁসে ও পানিতে ভিটামিনের পরিমাণ খুব কম, তবে পানিতে প্রতি ১০০ মি.লি. তে ৩০ গ্রাম ক্যালসিয়াম, ০.১ মিলি গ্রাম লৌহ, ৩৭ মিলি গ্রাম ফসফরাস ও যথেষ্ট পরিমাণে অন্যান্য খনিজ লবণ আছে। বাংলাদেশে উৎপাদিত মোট নারিকেলের শতকরা ৩৫-৪০ ভাগ ডাব হিসেবে ব্যবহৃত হয় বলে জানা যায় ।

 

ডাবের পানির স্বাস্থ্য গুনাগুণ:

ডাবের পানি যতটা না সুস্থ মানুষের প্রয়োজন, তারচেয়েও বেশি প্রয়োজন অসুস্থ মানুষের। বর্তমানে ডেঙ্গুজ্বর যে মহামারি আকার ধারণ করেছে, তার প্রতিষেধক হিসাবে ডাবের পানির উপকারিতা বলে শেষ করা যাবে না। ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে পানির ঘাটতি বেশি থাকে। সেজন্য চিকিৎসকরা পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ পানি খাওয়াতে পরামর্শ দেন। সে ক্ষেত্রে ডাবের পানির বিকল্প কিছু নেই। ডাবের পানিতে থাকা অ্যামাইনো অ্যাসিড ও ডায়াটারি ফাইবার ইনসুলিনের কর্মক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। ফলে ডেঙ্গুজ্বরসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে আনার কাজও করে থাকে।

বিশেষ করে ডেঙ্গু রোগীদের উদ্দেশে বলা যেতে পারে; ডাবের পানিতে যে পরিমাণ পটাশিয়াম আছে, তা কিন্তু অসুস্থ ব্যক্তির দ্রুত চিকিৎসার জন্য অত্যন্ত উপকারী উপাদান। কেননা, জ্বরের সময় প্রচণ্ড ঘাম হয়। এতে মাংসপেশিতে খিঁচুনি হয়। তখন রোগী কষ্ট পায়। রোগী যদি সামান্য পরিমাণ ডাবের পানি খেতে পারে, তখন ওই ঘাটতি পূরণ হয়।

এ ছাড়া ডেঙ্গুজ্বরে বা যে কোনো রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির অনেক উপায়ে সাহায্য করে ডাবের পানি। যেমন-শরীরে বিভিন্ন পেশির বাধা প্রতিরোধে ডাবের পানির বিশেষ গুণ হলো এটি অত্যন্ত পটাশিয়াম সমৃদ্ধ একটি পানীয় খাদ্য। এটি শরীরে বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষতিগ্রস্ত পেশিগুলোকে সচল করে দেয়।

হতাশা এবং রক্তচাপ কমাতে : ডাবের পানিতে রয়েছে প্রাকৃতিক চিনি, যা সব অসুস্থ ব্যক্তির মানসিক হতাশা দূর করতে সাহায্য করে। এটি পান করে চাহিদা পূরণের পাশাপাশি তৃপ্তিও পাওয়া যায়। এতে রয়েছে ইলেক্ট্রোলাইট, যা অসুস্থ ব্যক্তির রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে।

পুষ্টিতে ভরপুর : নিত্যদিনের সাধারণ পানীয় দ্রব্য থেকে ডাবের পানি অত্যন্ত পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ। এতে মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় পাঁচটি জরুরি উপাদান রয়েছে। যেমন-ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফরাস ও সোডিয়াম।

অবসাদ দূর করতে : বিশেষ করে বর্তমানে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তি অসুস্থ থাকা অবস্থায় বা সুস্থ হওয়ার পরও অবসাদগ্রস্ত থাকেন। তাদের জন্য ডাবের পানির পুষ্টিগুণ অনেক কার্যকর ভূমিকা রাখে। ডাবের পানি শরীরের ইলেক্ট্রোলাইটের পরিমাণ ঠিক রাখে। নিম্নে ডাবের পানির বিভিন্ন স্বাস্থ্য উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

১। ওজন কমাতে ডাব:

ওজন কমাতে ডাবের পানির চমৎকার ভুমিকা রয়েছে। এতে কোনো চর্বি বা কোলেস্টেরল থাকে না ও এতে চিনির পরিমাণও অল্প থাকায় নিশ্চিন্তে পান করা যায় যতটুকু ইচ্ছা। এছাড়াও ডাবের পানির চর্বি ধ্বংস করতেও সাহায্য করে। প্রচুর পরিমাণে খনিজ উপাদান থাকায় বাড়ন্ত শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবাই উপকারী এই ডাবের পানি পান করতে পারেন । এছাড়া তারুণ্য ধরে রাখতেও ডাবের পানি যথেষ্ট ভুমিকা রাখে।

২। ত্বক সুন্দর রাখতে ডাব:

ডাবের পানি ত্বকের জন্যও খুবই উপকারী । একটি ডাবের প্রায় ৯৪ শতাংশই পানি থাকে। ত্বকের সৌন্দর্য রক্ষা সহ পুরো দেহের শিরা-উপশিরায় সঠিকভাবে রক্ত চলাচল করতে এই পানি সাহায্য করে। ডাবের পানি বেশি পান করলে কিডনির কাজ করতে সুবিধা হয়, দেহে অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্তের সরবরাহ বাড়ে। ফলে ত্বকসহ প্রতিটি অঙ্গে পৌঁছায় বিশুদ্ধ রক্ত এবং পুরো দেহ সতেজ ও শক্তিশালীহয়ে ওঠে।

৩। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ডাব:

ডাবের পানির মধ্যে কিছু এন্টি ব্যাকটেরিয়াল ও এন্টি ভাইরাল উপাদান থাকায় এই পানি ব্যকটেরিয়া ও ভাইরাস মারতে অনেক কার্যকরী ভুমিকা রাখে। তাই প্রত্যেক দিন খাবারসহ অন্যান্য মাধ্যমে আমাদের শরীরে যেসব ব্যকটেরিয়া ও ভাইরাস প্রবেশ করে সেগুলো মারার জন্য এক গ্লাস ডাবের পানি খাওয়া যেতে পারে।

৪। হজম শক্তি বৃদ্ধি ও বদহজম দূর করতে ডাব:

হজম সমস্যা সমাধানে ডাবের পানি কাজ করে। ডাবের পানি পান করলে হজম শক্তি বৃদ্ধিসহ বদহজম দূর হয় । ডাবের পানি গ্যাসট্রিক , আলসার , কোলাইটিস , ডিসেন্ট্রি এবং পাইলসের সমস্যা দূরীকরণেও সাহায্য করে।

৫। কিডনির সুরক্ষায় ডাব:

ডাবের পানির অসাধারণ স্বাস্থ্যোপকারিতাগুলোর একটা হলো কিডনিতে পাথর জমতে বাঁধা দেওয়া। স্ফটিকজাতীয় পদার্থের উপস্থিতির ফলে কিডনিতে পাথর হওয়ার মতো ঝুঁকিপূর্ণ স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। এই যাওয়া অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। গবেষণায় দেখা গেছে যে ডাবের পানি কিডনি থেকে এই স্ফটিকজাতীয় পদার্থ মূত্রত্যাগের মাধ্যমে দেহের বাইরে বের করে দিতে যথেষ্ট কার্যকর ভুমিকা রাখে।

৬। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ডাব:

ডাবের পানির প্রাকৃতিক পুষ্টিগুণ শরীরের রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখে ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে হৃদঝুঁকি কমে যায়। পাশাপাশি অন্যান্য কার্ডিওভাসকুলার বিষয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া ডাবের পানি শরীরের ভেতরে অতিরিক্ত সুগার লেভেলকেও নিয়ন্ত্রয়ে আনতে ভুমিকা রাখে।

৭। হাড় ও পেশীর গঠনে ডাব:

হাড় ও পেশীর সুরক্ষায় ডাবের পানির কোনো বিকল্প নেই। হাড়ের ঘনত্ব ঠিক রাখতে ক্যালসিয়াম অতি দরকারি উপাদান। এই প্রয়োজনীয় উপাদানের দ্বারা সমৃদ্ধ থাকে ডাবের পানি। এছাড়া এতে উপস্থিত ম্যাগনেসিয়াম হাড়ের ঘনত্ব বৃদ্ধিসহ অন্যান্য কাজে সহায়তা করে। পেশী গঠন ও সচল রাখতেও কাজে দেয় ডাবের পানি সাহায্য করে।

৮। গর্ভবতী ও স্তন্যদায়ী মায়ের স্বাস্থ্য রক্ষায় ডাব:

গর্ভবতী ও শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন এমন মায়েদের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্যও প্রকৃতির এক অতুলনীয় দান এই ডাবের পানি। গর্ভকালীন বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা কাটাতে যেমন সকালের অস্বস্তি, বমি বমি ভাব, মাংসপেশিতে টান ইত্যাদি দূর করতে ডাবের পানির তুলনা নেই। বুকের দুধ খাওয়ানো মায়েদেরও নিয়মিত ডাবের পানি খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয় কারণ এটি তাদের বুকের দুধে রোগ প্রতিরোধকারী উপাদান বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে।

আরও দেখুন : 

Leave a Comment