আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় মসলা শুকনো ও সংরক্ষণ
Table of Contents
মসলা শুকনো ও সংরক্ষণ
মসলা শুকনো ও সংরক্ষণ
সংরক্ষণ একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বীজ শুধু উৎপাদন করলেই চলে না। বীজ উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এমনভাবে সংরক্ষণ করতে হবে যাতে পরবর্তী ৩ মাস থেকে ১২ মাস সময়ের মধ্যে নষ্ট না হয়ে যায়। কারণ এ সময়ের আগে বীজ সাধারণত ফসল উৎপাদনের জন্য বপন করা হয় না। নিম্নে প্রধান প্রধান মসলা ফসলের শুকানো ও সংরক্ষণ বর্ণনা করা হলো-
মরিচ :
কাঁচামরিচ স্বাভাবিক পরিবেশে ২-৩ দিন রাখা যায়। তবে আবহাওয়া ঠাণ্ডা থাকলে ৫-৭ দিন পর্যন্ত রাখা যায়। কাঁচা মরিচে পানি দেয়া যাবে না। তাতে মরিচ পচে যাবে। কাচামরিচ ৩২° C তাপমাত্রায় ৯৫-৯৮% আর্দ্রতায় ৪০ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। সংরক্ষণের জন্য পাকা মরিচ বোঁটাসহ তুলে ৩-৪ দিন ঘরে রাখতে হয়। এতে করে মরিচের কিছুটা কাঁচা ভাব থাকলেও সেগুলো ঠিকমতো পেকে যায় এবং রং ধারণ করে।
সংরক্ষণের জন্য কাঁচা ও আধাপাকা মরিচ তোলা হলে শুকানোর সময় তা নষ্ট হয়ে যায়। বাঁশের চাটাই বা পাটি বা পাকা ছাদের উপর ৮-১০ দিন সকাল ৯টা হতে বিকাল ৫টা পর্যন্ত পাকা মরিচ কড়া রোদে শুকাতে হয়। পাকা মরিচের শতকরা ২৫-৩০ ভাগ শুকনা মরিচ পাওয়া যায়। অর্থাৎ ১০০ কেজি পাকা মরিচ হতে ৩০-৩৫ কেজি শুকনা মরিচ পাওয়া যায়। মরিচ ঠিকমতো শুকনা হলে হাত দিয়ে চাপ দিলে মচমচ করবে এবং ভেঙে যাবে।
পাকা মরিচ ৪-৫ দিন শুকানোর পর মরিচের উপর কাঠের তক্তা বা ভারী কিছু জিনিস দিয়ে চাপ দিলে মরিচগুলো চ্যাপ্টা হয়ে যায়। এতে মরিচ সংরক্ষণের সুবিধা হয় এবং অল্প স্থানে বেশি মরিচ রাখা যায়। মরিচ শুকানোর পর ঠান্ডা করে পলিব্যাগ বা চটের বস্তায় রাখা যায়। মরিচ শুকানোর সময় বৃষ্টি হলে চুলার তাপেও মরিচ শুকানো যায়।
মরিচকে রোদ বা চুলার তাপে যেখানেই শুকানো হোক না কেন বারবার ওলটপালট করে দিতে হয়। তাতে সমানভাবে মরিচের সবদিক শুকাতে পারে। শুকনা মরিচের বোটা ছিঁড়ে মেশিনে ভাঙ্গিয়ে মরিচের গুঁড়া করা হয়।
হলুদ :
হলুদ সিদ্ধকরণ মাটি থেকে হলুদ তোলার পর হলুদের গায়ের মাটি ও শিকড়গুলো পরিষ্কার করে নিতে হবে। তারপর একটি পাত্রে হলুদ ও পানি ভর্তি করে ৩০-৪০ মিনিট জ্বাল দিতে হবে। জ্বাল দেয়ার সময় পাত্রের পানি দুইবার ফুটে উঠলে হলুদ সিদ্ধ হবে। ২/১টি হলুদ ভেঙে ইটের মতো রঙ দেখা গেলে হলুদ সিদ্ধ হয়েছে বুঝতে হবে। তবে হলুদের গায়ের রং কালচে হওয়া পর্যন্ত হলুদ সিদ্ধ করতে হবে।
হলুদ সিদ্ধ হলে হলুদগুলো ছেঁকে তুলে নিতে হবে এবং এই জ্বালের গরম পানি পুনরায় হলুদ সিদ্ধের কাজে লাগাতে হবে। সিদ্ধ করা মোটা হলুদ কেটে ফালি করে পাতলা করতে হবে। সিদ্ধ হলুদ ৩-৪ সপ্তাহ রোদে শুকাতে হবে। প্রথম সপ্তাহে শুকানোর সময় প্রত্যহ ৩-৪ বার উলটপালট করে দিতে হয়। দ্বিতীয় সপ্তাহে দিনে ২ বার হলুদে ডলা দিতে হয়। এর ফলে হলুদ গোল পেন্সিলের মতো হয়। হলুদ ঠিকমতো না শুকালে গুঁড়াকরা যাবে না।
হলুদ ভালোভাবে শুকানোর পর ভেঙে দেখলে পাথরের মতো দেখাবে ও শক্ত জিনিসের সাথে আঘাত করলে টনটন শব্দ হবে। এছাড়া হলুদের রং সুন্দর করার জন্য চটের বস্তায় ভরে বার বার আছাড় দেওয়া হয় বা লাঠি দিয়ে পিটানো হয়। এতে হলুদের রং উজ্জ্বল হয়। অতঃপর হলুদ বস্তায় ভরে উঁচু মাচায় বা গোলাঘরে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়।
আদা :
আদাকে দুইভাবে সংরক্ষণ করা যায়। যথা- বাকলসহ ও বাকলবিহীনভাবে আদা সংরক্ষণ। বাকলসহ আদা আবার দুইভাবে সংরক্ষণ করা যায় যেমন- বালুতে সংরক্ষণ ও শুকিয়ে সংরক্সণ। বাকলসহ বালুতে সংরক্ষণের জন্য মাটিতে গর্ত করে তাতে আদা ও বালু ১ঃ১ অনুপাতে গর্ত ভর্তি করে বালু দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। গর্তে যেন পানি প্রবেশ না করে এজন্য ছাউনির ব্যবস্থা করতে হবে।
বাকলবিহীন আদা দুইভাবে সংরক্ষণ করা যায়। যথা- শুকানো বা Cured আদা এবং প্রক্রিয়াজাত বা সবুজ আদা (Green ginger)। শুকানো আদা তৈরিতে আদার বাকল ফেলে রোদে শুকানো হয়। খোসা ছাড়াবার পূর্বে আংশিক সিদ্ধ করে নিতে হয়। ইহাকে কালো আদা বলে। তবে আদাকে ব্লিচিং করে নিলে তা সাদা আদায় পরিণত হয়।
গোলমরিচ :
আমরা বাজারে যে কাল গোলমরিচ মশলা হিসেবে দেখি তা গাছের শুকনো অপক্ক ফল। ফল সংগ্রহ করার পর ৮-১০ দিন রোদে শুকালে ফল কিঞ্চিত কুঁচকে গিয়ে কালো বর্ণ ধারণ করে। আন্তর্জাতিক বাজারে এটাই গোলমরিচ বা ব্ল্যাক পিপার। ১০০ কেজি কাঁচা ফল হতে ৩০- ৩৫ কেজি কাল গোলমরিচ ও ২৬-২৭ কেজি সাদা গোলমরিচ পাওয়া যায়। শুকানো গোলমরিচ হাতে চাপ দিলে শক্ত লাগে এবং দাঁতে চাপ দিলে পুটপুট শব্দ করে ফেটে গেলে বুঝতে হবে ঠিকমতো শুকিয়েছে।
দারুচিনি :
৩-৪ বছরের গাছ থেকেই দারুচিনির সংগ্রহ করা যায়। নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের আঙ্গুলের চেয়ে মোটা ডাল কেটে দু’ফালি করে ছাল ছড়ায়ে আলাদা করা হয়। ছাল বা বাকলই দারুচিনি মসলা । বাকলগুলো জমা করে মোটা কাপড় বা বস্তা দিয়ে স্তূপ করে ঢেকে পচানো হয়।
চিত্র : দারুচিনির কুইল
পরে ছুরি দিয়ে বাহিরের ত্বক চেঁছে ফেলা হয়। তারপর বাকলগুলো ৩-৪ দিন রোদে ভালো করে শুকানো হয়। শুকানোর পর বাকলগুলো শুকিয়ে চোঙ্গার আকার ধারণ করে। একে কুইল বলে। এই অবস্থায় দারুচিনি বস্তাবন্দি করে রপ্তানি করা হয়।
ধনিয়া :
ধনিয়া পাকলে হাতে নিয়ে ডলা দিলে সহজেই ভেঙে দুই টুকরা হবে। এ অবস্থায় ধনিয়ার গাছ তুলে রোদে ভালোভাবে শুকায়ে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে বা গরু দিয়ে মাড়াই করতে হয়। মাড়াই করা বীজ আলাদা করে পরিষ্কার করে রোদে ভালোভাবে শুকাতে হয়। ধনিয়ার আর্দ্রতা ৫-৬.৫ ভাগ নেমে আসলে বীজগুলো হাতে নিয়ে চাপ দিলে মচমচ শব্দ করবে।
এছাড়া দাঁতের নিচে চিবুলে মচমচ শব্দ এমনকি অনেক সময় মুড়ির ন্যায় গুঁড়া হয়ে যাবে। ঠান্ডা করে চটের বা পলি ব্যাগে ভর্তি করে উঁচু, শুকনা ও ঠাণ্ডা স্থানে রাখতে হয়।
রসুন:
পেয়াজের চাইতে রসুন সংরক্ষণ করা সহজ। রসুন মাঠ হতে তোলার পর গাছসহ ঝাড়সহ একত্রে ২/১ দিন জমা করে রাখা হয়। পরবর্তীতে রসুনের শিকড় কেটে ৪-৫ দিন ছায়ায় শুকাতে হয়। অনেক সময় শিকড় ও গাছ কেটে ১ দিন রোদে শুকায়ে ধুলাবালি ঝেড়ে আলোবাতাসযুক্ত স্থানে রাখা হয়।
শুধু শিকড় কাটা শুকানো রসুনের গাছগুলো মুঠি আকারে বেঁধে রশিতে বা বাঁশের সাথে ঝুলায়ে রাখা যায়। প্রক্রিয়াজাত করেও রসুন রাখা যায়। যেমন- লবণ রসুন, রসুনের পাউডার, রসুনের সস ও রসুনের আচার ইত্যাদি।
আরও দেখুন :