শিল্পজাত সয়া খাদ্য

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় শিল্পজাত সয়া খাদ্য

শিল্পজাত সয়া খাদ্য

শিল্পজাত সয়া খাদ্য

সয়াবিন থেকে শিল্প পর্যায়ে খাবার তৈরি করতে হলে প্রথমে সয়াবিন ময়দা তৈরি করতে হয়। তারপর ময়দা দ্বারা সয়া চানাচুর, সয়া নাগেট, সয়া ছানা, সয়া দধি সয়া দুধ, মাংস ইত্যাদি বানানো যায় ।

সয়া ময়দা :

ফুটন্ত পানিতে সয়াবিন ২০ মিনিট কাল সিদ্ধ করতে হয়। তবে পানি ফুটিয়ে জ্বাল দেওয়ার সময় ০.৫% সোডিয়াম বাই কার্বোনেট মিশিয়ে নিলে সয়াবিনে ক্ষতিকারক উপাদান অপসারিত হয়। সিদ্ধ সয়াবিন পরিষ্কার পানিতে ডলে খোসা ছাড়িয়ে নিতে হয় অতঃপর তা পাটিতে বা মাদুরে বিছিয়ে রোদে ভালোভাবে ২-৩ দিন শুকিয়ে নিতে হয়।

সয়াবিন শুকিয়ে কটকটে থেকে হয়। দাঁত দিয়ে কামড় দিলে কটকট শব্দ করবে এবং ভেঙে দুই টুকরা হয়ে যাবে। এবার গম ভাঙানোর মেশিনে বেটে সয়া ময়দা তৈরি করা যায়। বায়ুরোধী অবস্থায় সয়াময়দা ৩ মাস সংরক্ষণ করা যায়। ৫°C তাপমাত্রায় ও ৫৯% আপেক্ষিক আর্দ্রতায় সয়া ময়দা পলিথিনে বায়ুরোধী করে রাখলে ভালো থাকে।

শিল্প পণ্য তৈরিতে সময় সয়া ময়দার সাথে বিভিন্ন অনুপাতে গমের ময়দা মিশাতে হয়। কেননা সয়া ময়দায় গ্লুটেন না থাকায় গমের ময়দা (যা গ্লুটেনসমৃদ্ধ) বিভিন্ন খাদ্য দ্রব্য তৈরিতে সুবিধা হয়।

 

শিল্পজাত সয়া খাদ্য

চিত্র: সয়াবিন থেকে নাগেট, মাংস, দুধ তৈরি ।

সয়া চানাচুর :

সয়া চানাচুরের জন্য সমপরিমাণ সয়া ময়দা, গমের ময়দা ও খেসারি বা ছোলার বেসন নিতে হবে। বেসন টাটকা হলে হাইড্রোজ লাগে না পুরানো বেসন হলে হাইড্রোজ ব্যবহারের প্রয়োজন হয়। ‘সকল ময়দা, বেসন, সয়াবিন, তেল, লবণ, মশলার গুঁড়া ও পরিমাণমতো পানি দিয় মণ্ড বা খামির তৈরি করতে হয়। সামান্য রং গুলিয়ে মণ্ডের সাথে মিশিয়ে দিতে হয়।

এরপর খেসারি ডালের বেসন দিয়ে ঝুরি তৈরির মতো করে ঝুরি তৈরি করতে হয়। ঝুরির সাথে পরিমাণমতো বাদাম ভাজা, ডাল ভাজা, চিড়া ভাজা, মটর ডালভাজা প্রভৃতি মিশিয়ে ছোট ছোট প্যাকেট করে বিক্রির জন্য রাখা হয়। চানাচুরকে মুখরোচক করার জন জিরাভাজা গুঁড়ো বা অন্য কোনো মশলা মেশানো যেতে পারে ।

সয়া দুধ :

সাধারণত দুই পদ্ধতিতে সয়া দুধ তৈরি করা যায়া : যথা ক) সাধারণ পদ্ধতি ও খ) আইএমএফ পদ্ধতি।

সাধারণ পদ্ধতিতে সয়া দুধ :

প্রথমে নিয়ামনুযায়ী সয়া ময়দা তৈরি করতে হবে। এছাড়া বেন্ডারে সয়াবিন মিহি করে গুড়া করা যায়। পানি মিশিয়ে শিলপাটার পেষা বা মেশিনে গুঁড়া করা সয়াবিন বেশ গাঢ় হয়। এ গাঢ় সয়াবিনকে লেই বলে। তারপর ৫:১ অনুপাতে ঈষদুষ্ণ পানি ও সয়াবিন মিশিয়ে ভালোভাবে নেড়ে দিতে হয়। এরপর এ মিশ্রণ পাতলা পরিষ্কার কাপড়ের সাহয্যে ছেঁকে দুধ বের করে অন্য একটি পাত্রে নিতে হয়।

ছাঁকার পর অবশিষ্ট সয়াবিনের কাই আলাদা করে অন্য খাবারে ব্যবহার করা যায়। প্রাপ্ত সয়া দুধে চিনি এবং মশলা মিশিয়ে মৃদু জ্বালে প্রায় ১৫-২০ মিনিট ফুটিয়ে চুলা থেকে নামিয়ে ঈষদুষ্ণ অবস্থায় খাওয়া যায়। এ দুধ সহজে হজমযোগ্য যা গরুর দুধের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

সয়া দুধের সাথে গরুর দুধ মিশিয়ে অথবা ভিটামিন বি১, বা বি১২ মিশিয়ে পুষ্টিমান বাড়ানো যায়। অনেক সময় সুগন্ধি মিশিয়ে রুচিসম্মত করা যায়।

আই, এম, এফ পদ্ধতিতে সয়া দুধ :

পুষ্ট পরিপক্ব রোগমুক্ত বাছাই করা সয়াবিন ৯০°C তাপমাত্রায় ১৫ মিনিট এয়ার ড্রায়ার (Air drier) মেশিনে শুকিয়ে নিতে হয়। শুকানোর পর ডিহলার (Dehuller) মেশিনে সয়াডাল ভাঙিয়ে এসপিরেটারের (Aspirator) সাহায্যে খোসা ছাড়িয়ে নিতে হয়।

এ খোসা ছাড়ানো সয়া ডাল স্টিম জ্যাকেটেড কেটলিতে নিয়ে শতকরা ০.২৫ ভাগ বেকিং সোডা মিশিয়ে ফুটন্ত পানিতে ৫ মিনিট ফুটাতে হয়। ফুটানোর পর সম্পূর্ণ পানি ফেলে দিয়ে ৯৫°C তাপমাত্রায় গরম পানি দিয়ে ধুতে হয়।

ধোয়া সয়াবিন পুনরায় ০.০৫ ভাগ বেকিং সোডা মিশানো ফুটন্ত পানিতে ৫ মিনিট ফুটিয়ে পানি ফেলে দ্বিতীয়বার ৯৫°C তাপমাত্রায় গরম পানিতে ধুতে হবে।

এখন ডিজইনটেগরেটর (Disintegrator) বা বিয়োজিত করা মেশিনের সাহায্যে গরম পানি সহযোগে ফ্লারি (Slurry) মণ্ড প্রস্তুত করতে হবে। রোলার সয়ামিল্ক এক্সট্রাক্টটর (Roller Soya milk Extactor) সাহায্যে অর্থাৎ রোলারের চাপে দুধ নিষ্কাশন করে নেওয়া হয়। এ নিষ্কাশিত দুধ ৯৫°C তাপে ১৫-২০ মিনিট হালকাভাবে ফুটিয়ে নিতে হয়।

অন্যদিকে দুধ নিষ্কাশনের পর ছাঁকনির উপর পড়ে থাকা অদ্রবণীয় পাউডার ও আঁশ জাতীয় পদার্থ অন্য খাবার তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।

মৃদু জ্বালে হালকাভাবে ফুটানো দুধ এখন হোমজিনাইজার ( Homoginizer) এর সাহায্যে প্রথম ধাপে ৩৫০০ পিএসআই এবং দ্বিতীয় ধাপে ৫০০ পি এস আই চাপে ৯৫°C তাপে হোমজিনাইজড সয়াবিনের দুধের সকল উপাদান ভেঙ্গে সংমিশ্রণ করে দুধের সান্দ্রতা সর্বত্র সমরূপ করা বা সমঘনত্ব করতে হয়।

এরপর এয়ারকুলার (Air Cooler) বা ফ্যানের সাহায্যে ১৫ সেকেন্ডের মধ্যে ১০°C তাপমাত্রায় ঠাণ্ডা করতে হয়ে। এ ঠাণ্ডা দুধ বাণিজ্যিক প্লাস্টিক বোতলে ৪°C তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করে খাওয়া যায়।

আই এম এফ পদ্ধতিতে সয়াদুধ তৈরির প্রবাহ চিত্র-

 

শিল্পজাত সয়া খাদ্য

 

সয়াদুধ বোতলজাত করে কোমল পানীয়ের মতো বিভিন্ন দেশে বাজারজাত করা হয়। ইদানীং এটি সিঙ্গাপুর, মালায়েশিয়া ও পার্শ্ববর্তী দেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। সয়াদুধের অবশিষ্টাংশের সাথে চালের গুঁড়া, গুড়, তেল, লবণ ও পানি দিয়ে পিঠা তৈরির নিয়মে সয়া মিষ্টি পিঠা তৈরি করা যায়।

সয়াদুধের সাথে গাভি, মহিষ, ছাগির ও মাতৃদুগ্ধে বিদ্যমান পুষ্টিমানসমূহের তুলনা (প্রতি ১০০ মিলি লিটারে) নিম্নের ছকে দেখানো হলো-

 

শিল্পজাত সয়া খাদ্য

উৎস: সয়াবিন থেকে তৈরি খাবার- বি.এ.আর.আই, ২০০৮ ইং

সয়ামাংস বা সয়া ছানা :

দেড় লিটার সয়াদুধ জ্বাল দিয়ে ফুটন্ত দুধে পরিমাণমতো লেবুর রস বা সিরকা মিশিয়ে আস্তে আস্তে নাড়তে হয় এবং দুধ জমতে শুরু করলে চুলা থেকে নামিয়ে নিতে হয়। ২-৩ মিনিটের মধ্যে সবটুকু দুধ জমে যাবে। জমা দুধ পরিষ্কার পাতলা কাপড় দ্বারা ছেঁকে সবটুকু ছানা আলাদা করে নিতে হবে। কাপড় খুব জোরে চেপে যতটুকু সম্ভব পানি বের করে নিতে হবে।

কাপড়টি ১৫-২০ মিনিট ঝুলিয়ে রাখার পর কাপড় থেকে ছানা বের করে নিতে হয়। উক্ত ছানা পছন্দ অনুযায়ী আকার দিয়ে ছোট ছেট টুকরা করে ভেজে মশলা মিশিয়ে তরকারিতে মাংসের পরিবর্তে ব্যবহার করা যায়। টুকরোগুলো ঠাণ্ডা পানিতে রাখলে এবং প্রতিদিন পানি পাল্টালে ৫-৬ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।

সয়া দধি :

দেড় লিটার সয়াদুধের সাথে (১:৪) অনুপাতে গরুর দুধ বা গুঁড়া দুধ মিশিয়ে ১৫-২০ মিনিট জ্বাল দিতে হয়। জ্বাল দেওয়ার সময় ৩০০ গ্রাম চিনি ও পছন্দমতো মশলা মিশিয়ে আরও কিছুক্ষণ জ্বাল দিয়ে ঘন করে নিতে হয়।

দধি যে পাত্রে তৈরি করা হবে সে পাত্রটি প্রথমে ১ চা চামচ টক দধি দ্বারা মুছে কুসুম গরম দুধ ঢেলে নিয়ে ১০ মিনিট খোলা রাখতে হয়। পরে পাত্রের উপর পরিষ্কার সাদা কাগজ দ্বারা ঢেকে রাখলে ৬-৭ ঘণ্টা পর সম্পূর্ণ দধি প্রস্তুত হয়।

আরও দেখুন : 

Leave a Comment