আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় মুগ ডাল ও মটর ডাল থেকে বিভিন্ন খাদ্য তৈরি
Table of Contents
মুগ ডাল ও মটর ডাল থেকে বিভিন্ন খাদ্য তৈরি
মুগ ডাল ও মটর ডাল থেকে বিভিন্ন খাদ্য তৈরি
সব ধরনের ডালের মধ্যে মুগ ডাল ও মটর ডাল অন্যতম। মুগডাল ও মটর ডাল থেকে বহু ধরনের খাদ্য তৈরি করা যায়। তন্মধ্যে কয়েকটির নাম দেয়া হলো-
(১) মুগ ডালের পরোটা
(২) মুগ ডালের পাকোড়া
(৩) মুগাঙ্কুর
(৪) চিড়া ডালমুট
(৫) দই বড়া
(৬) মটর ডাল থেকে চানাচুর
(৭) মটর চটপটি ইত্যাদি
মুগডালের পরোটা :
এটি তৈরি করতে মুগডাল, গমের আটা, পালংশাক, পিঁয়াজ, তেল বা ঘি, জিরা, লবণ ও মরিচের গুঁড়া লাগবে। প্রথমে জিরা ভেজে নিতে হয়। পালংশাকের সাথে পিঁয়াজ কুচি মিশাতে হয়। তারপর মুগডাল বাটা, আটা, পালং পাতা, পিঁয়াজ কুচি, জিরা, লবণ ও মরিচ গুঁড়া ভালো করে মিশিয়ে খামির তৈরি করতে হবে। খামির থেকে রুটি তৈরির মতো বল করে পিঁড়ি বেলুন দ্বারা বেলে রুটি তৈরি করে তেল বা ঘিতে ভেজে নিতে হয়।
মুগডালের পাকোড়া :
পাকোড়া তৈরিতে মুগডাল, পালংশাক, তেল বা ঘি লবণ, গুঁড়া মরিচ, মশলা, সস বা চাটনি প্রয়োজন হয়। প্রথমে ডাল ৬-৮ ঘণ্টা ভিজিয়ে ব্লেন্ডারে বা শিলপাটায় বেটে নিতে হয়। পালংশাক ভালো করে ধুয়ে কেটে বাটা ডাল, শাক ও সব মসলা, লবণ ভালো করে মিশিয়ে কাই বা খামির তৈরি করতে হয়। ছোট ছোট বলের মতো তৈরি করে ডুবো তেলে ভেজে তুলতে হয়। সস্ বা চাটনি সহযোগে খেতে দেওয়া হয়।
অঙ্কুরিত মুগের সালাদ (মুগাঙ্কুর) :
আমাদের দেশে খাদ্য তালিকায় ডাল হিসেবে খাবার ছাড়া মুগের ব্যবহার অত্যন্ত কম। মুগবীজ থেকে তৈরি মুগাঙ্কুর একটি উৎকৃষ্ট সবজি হিসেবে আমাদের দেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। মুগাঙ্কুর থেকে বিভিন্ন উপাদেয় খাবার তৈরিসহ মাছ, মাংস ও অন্যান্য সবজির সাথে খাওয়া যায়।
এটিতে শর্করা, আমিষ, খনিজ লবণসহ প্রচুর ভিটামিন-সি থাকে। পুষ্ট, পরিপক্ব বীজ ৩-৪ দিন পানি ছিটিয়ে ভিজিয়ে ৩-৪ সেমি, লম্বা অঙ্কুর বৃদ্ধি হলে তা খাবার হিসেবে খাওয়া যায়, সাধারণত ১ কেজি বীজ থেকে ৮-৯ কেজি মুগাঙ্কুর উৎপন্ন হয়। সালাদ তৈরর জন্য আস্ত মুগবীজ ১২ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে পানি ঝরিয়ে নিতে হয়।
৩-৪ দিন পর অঙ্কুর বের হলে প্রেসার কুকারে সামান্য পানি দিয়ে ৫ মিনিট সিদ্ধ করতে হয়। পেঁয়াজ কুচি, কাঁচা মরিচ, ধনে পাতা, টমেটো ও শসা কুচি মিশাতে হবে। অত:পর লেমন জুস, লবণ ও গুঁড়া মরিচ মিশিয়ে মুগের সালাদ পরিবেশন করতে হয়।
চিত্র: মুগ ডালের পরোটা, পাকোড়া ও মুগাঙ্কুর
চিড়া ডালমুট তৈরি : চিড়া ডালমুট তৈরির উপাদানগুলো হলো চিড়া, মুগডাল, মরিচ গুঁড়া, লবণ, সাইট্রিক এসিড, বিট লবণ ও বেকিং পাউডার ইত্যাদি। হলুদ গুঁড়া মুগডাল ভালোভাবে পরিষ্কার করে ২ গ্রাম বেকিং পাউডার দিয়ে ১ রাত ভিজিয়ে রাখতে হয়। চিড়া বেছে পরিষ্কার করতে হয়।
ডালে হলুদ, মরিচ ও লবণ মিশাতে হয়। কড়াইতে তেল গরম করতে হয়। তেল যখন গরম হবে তখন ধোঁয়া উঠতে থাকবে। এ সময় চিড়া ঢেলে দিয়ে তেলে ভাজতে হয়। ভাজা হলে তেল ঝরিয়ে রেখে ঠান্ডা করতে হয়। তারপর একই পদ্ধতিতে ডাল ভাজতে হয়।
চিড়া ভাজা ও ডাল ভাজা একত্রে মিশিয়ে গুঁড়া মশলা, সাইট্রিক এসিড, বিট লবণ মিশ্রিত করে ছোট ছোট প্যাকেট করতে হয়। চিড়া ডালমুটে চিনাবাদাম ভেজে দেওয়া যেতে পারে। তারপর প্যাকেট বায়ুরোধী করে বাজারজাত করা হয়।
দইবড়া :
এটি পুরাতন নবাবী আমলের খাবার। এটি মসলা মেশানো টকদই দিয়ে মাষকলাই ডালের বড়া রান্নার পদ্ধতি। এটি বেশ তীব্র স্বাদযুক্ত খাবার। এটি সাধারণত রুচিবর্ধক খাবার হিসেবে ব্যবহার হয়। বাংলাদেশের পুরানো ঢাকাতে এখনও এ খাবারের প্রচলন আছে। যদিও বর্তমানে এর ব্যবহার প্রচলন সীমিত। রমজান মাসে ইফতারে এর আকর্ষণ বাড়ে। উত্তর ভারতের পাঞ্জাবী ও হরিয়ানী খাবারে দইবড়া বহুল ব্যবহৃত।
প্রস্তুত প্রণালি:
দই বড়া তৈরিতে মুগের ডাল, টকদই, সরিষার তেল, জিরা গুঁড়া, মরিচ গুঁড়া ও লবণ ইত্যাদি লাগে। মুগের ডাল ভাল করে বেছে ধুয়ে ২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। এরপর ডাল বেটে পরিমানমতো লবণ মিশিয়ে ভালো করে ফেটিয়ে নিতে হবে। এরপর মরিচ ও জিরা ভেজে গুঁড়া করে রাখতে হবে। বেশি ভাজা হলে তিতা হয়ে যাবে।
কড়াইতে তেল গরম করে ফেটানো ডাল দিয়ে বড়া ভেজে নিতে হবে। একটি আলাদা পাত্রে পানি রেখে ভাজা বড়াগুলো ভিজিয়ে রাখতে হবে। ১৫ মিনিট পরে বড়াগুলো তুলে প্লেটে রাখতে হবে ।
এরপর টক দই পরিমাণমতো বড়াগুলোর উপর ছড়িয়ে দিতে হবে। দই দিয়ে তার উপর জিরার গুঁড়া ও মরিচ গুঁড়া ছড়িয়ে দিতে হবে। সব শেষে একটু বিট লবণ দিলে খেতে ভালো লাগবে। দইবড়া মাষকলাই ডাল দিয়েও করা যাবে।
চানাচুর তৈরি :
চানাচুর তৈরির প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো হচ্ছে ছোলার ডালের বেসন, চিনাবাদাম, অর্ধভাঙ্গা মটর ডাল, চিড়া, জিরার গুঁড়া, ধনের গুঁড়া, সাইট্রিক এসিড, লবণ, ডিম, সয়াবিন তৈল ইত্যাদি।
প্রস্তুতপ্রণালি:
(১) ছোলার ডালের বেসনের সাথে এমনভাবে পানি মেশাতে হবে যাতে খামির অর্ধকঠিন অবস্থায় পরিণত হয়।
(২) খামিরের সাথে খাবার রং, ডিম, এসিড ও লবণ মিশিয়ে সাঁজ বা ডাইসে নিতে হয়।
(৩) চুলার কড়াইতে এমনভাবে সয়াবিন তেল নিতে হবে যাতে চানাচুরের টুকরোগুলো ডুবিয়ে ভাজা যায়। তেল ফুটলে তার উপর ডাইস রেখে অল্প পরিমাণ খামির নিয়ে হাতে চাপ দিয়ে তেলের মধ্যে প্রথমে ঝুরিগুলো ফেলা হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে বড় হাতাওয়ালা ছিদ্রযুক্ত চামচ দিয়ে আস্তে আস্তে নাড়তে হয়।
যখন ভাজা সম্পূর্ণ হয় তখন ঐ চামচ দিয়ে ঝুরি তেল থেকে তুলে নিয়ে তেল ঝরার জন্য ছিদ্রযুক্ত ট্রেতে রাখা হয়। খেয়াল রাখতে হবে ঝুরিগুলো যেন বেশি বা কম ভাজা না হয়। বিভিন্ন ডিজাইনের ঝুরি পেতে হলে ডাইসগুলো সে অনুযায়ী পরিবর্তন করে নিতে হয়।
(৪) চিনাবাদামকে খোসামুক্ত করে কিছু সময় পানিতে রাখতে হয়। তারপর পানি ঝরিয়ে তেলে ভেজে নিতে হয় ।
(৫) মটর ডাল প্রায় ৫-৭ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। তারপর পানি ঝরিয়ে তেলে ভেজে নিতে হয়।
(৬) চিড়াগুলো পরিষ্কার করে তেলে ভেজে নিতে হয়।
(৭) একটা টেবিলের উপর পলিথিন কাগজ বিছিয়ে তার উপর প্রস্তুতকৃত ঝুরি, বাদাম, ডাল, চিড়া, জিরার গুঁড়ো, ধনের গুঁড়ো ও মরিচের গুঁড়ো নিতে হয়। সব মিক্সার মেশিনে দিয়ে অথবা হাত দ্বারা ভালোভাবে মেশাতে হয়।
(৮) ইচ্ছানুযায়ী বিভিন্ন মাপের পলিথিন ব্যাগ নিয়ে তাতে চানাচুর তরে ভালোভাবে সিল করতে হয়।
(৯) চানাচুরে উপাদানগুলোর সংখ্যা ও পরিমাণের ভিন্নতা কমবেশি করে স্বাদের বৈচিত্রতা আনা যায় । এতে আলুর পেস্টও ব্যবহার করা যায়।
খেসারির বেসন দিয়ে ঘুরি তৈরি:
ঝুরি তৈরির জন্য খেসারির ডালের বেসন, খাবার সোডা, লবণ ও সয়াবিন তেলের প্রয়োজন হয়। প্রথমে বেসন, খাবার সোডা, লবণ, তৈল এক সাথে মেশাতে হয়। পানি সহযোগে মঞ্চ বা খামির তৈরি করতে হয়। চুলার উপর কড়াই বসিয়ে তেল গরম হলে চিকন ঝুরির ডাইস কড়াই- এর উপর বসাতে হয়।
ভাইলের উপর খামির দিয়ে হাতের তালু দিয়ে পিৰাতে হয়। চিকন ঝুরি পরম তেলের মধ্যে পড়বে। মেশিন ব্যবহার করলে মেশিনের সাহয্যে ঝুরি তেলের মধ্যে ফেলতে হয়। চিকন বুরি অল্প আঁচে ভেজে তুলে তেল ঝরিয়ে ঠাণ্ডা পলিথিন প্যাকেট করে বাজারজাত করা যায়। এই ঝুরি চানাচুরের সাথে মেশানো যায় বা আলাদাও প্যাকেট করে বিক্রি করা যায়।
খেসারির বেসন দিয়ে পাপড় তৈরি :
পাপড় তৈরির উপকরণ ঝুরি তৈরির মতো। ঝুরি তৈরির মতো বেসন, খাবার সোডা, লৰণ, কাঁচা তেল মিশাতে হয়। তারপর পানি দিয়ে মঞ্চ বা খামির তৈরি করতে হয়। চুলায় তেলের কড়াইয়ের উপর পাপড়ের ডাইস বসিয়ে হাতের তালু দিয়ে পিষতে হয়।
ডাইসের ছিদ্র দিয়ে পাতলা পাপড় গরম তেলে পড়বে এবং অল্প আঁচে ছোট ছোট পাপড় ভেজে তুলতে হয়। পাপড় ডাইস ছাড়া হাতেও বানানো যায় তবে তা উত্তম রূপে শুকাতে হবে। এটি চানাচুর তৈরির একটি প্রধান উপকরণ।
চিত্র : পাপড় তৈরি (হাতে বানানো
খেসারির বেসন দিয়ে পাতিয়া তৈরি :
ঝুরি ও পাপড় তৈরির মতোই গাটিয়া তৈরির উপকরণ একই রকম, শুধু গাটিয়া তৈরিতে অতিরিক্ত সামান্য কালিজিরা লাগে। গাটিয়া তৈরির পদ্ধতি ঝুরি ও পাপড়ের মতোই। গাটিরাও চানাচুরের একটি উপকরণ।
ছোলার ডাল ভাজা :
পরিষ্কার ও দুষ্ট ছোলার ডাল নিয়ে খাবার সোডা ও লবণ সহযোগে ৭-৮ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। তারপর ভালগুলো পানি ঝরিয়ে গরম তেলে ভেজে নিতে হয়। বাদাম ও চিড়া তেলে ভেজে চানাচুরের জন্য তৈরি করতে হয়। এগুলো আলাদাভাবে পলিথিন প্যাকেট করেও বাজারজাত করা যায়।
বোম্বাই চানাচুর :
বিট লবণ, সাইট্রিক এসিড, জিরা, আদা, গোলমরিচ ও দারুচিনির গুঁড়া সংগ্রহ করে বিট লবণ ও সাইট্রিক এসিড ছাড়া সব মশলা একত্রে হালকা আঁচে ভেজে নিতে হয়। চানাচুরের সাথে উপরে তৈরি সব উপকরণ যেমন- ঝুরি, পাপড়, পাটিয়া, ডাল ভাজা, বাদামভাজা, চিড়া ভাজা এক সাথে মিশাতে হয়। সেগুলোর সাথে সব মসলা, বিট লবণ, সাইট্রিক এসিড এক সাথে মিশিয়ে বোম্বাই চানাচুর পলিখি প্যাকেটে ভরে ভালোভাবে বায়ুরোধী করে মুখ বন্ধ করতে হয়।
মটর চটপটি :
চটপটি তৈরিতে মটর ডাল, বেকিং পাউডার, তেঁতুল, আলু, ডিম, ঘিন্না বা শশা, টমেটো, পেঁয়াজ, জিরা, শুকনো মরিচ, হলুদ গুঁড়া, কাঁচা মরিচ, ধনেপাতা কুঁচি, লবণ, সামান্য চিনির প্রয়োজন হয়। প্রথমে বাছাইকৃত পরিপক্ক মটর নিয়ে কিছু বেকিং পাউডার দিয়ে সারারাত ভিজিয়ে রাখতে হয়।
পরদিন সকালে মটরগুলো ভালোভাবে ধুয়ে বাকি বেকিং পাউডার ও হলুদ গুঁড়া দিয়ে সিদ্ধ করতে হয়। মটর সিদ্ধ হলে চুলা থেকে নামাতে হয়। মটরের প্রবনের উপরের মরণা জমলে তা তুলে ফেলতে হয়। পরদিন সকালে মটরগুলো ভালোভাবে ধুয়ে বাকি বেকিং পাউডার ও হলুদ গুঁড়া দিয়ে সিদ্ধ করতে হয়।
নতুন মটরে বেকিং পাউডার লাগে না বিশেষ করে চৈত্র-বৈশাখ মাসের নতুন মটর। তেঁতুল পানিতে ভিজিয়ে পান্ন বের করতে হয়। আলু ও ডিম সিদ্ধ করে ছোট ছোট স্লাইস তৈরি করতে হয়। জিরা ও মরিচ আলাদাভাবে গুঁড়া করতে হয়। পেঁয়াজ, শিরা ও টমেটো স্লাইস করতে হয়।
অল্প পানিসহ মটর, তেঁতুল, আপু, লবণ, চিনি ও অর্ধেক ঊড়া মশলা দিয়ে জাল দিতে হয়। তারপর ফুটে উঠলে নামাতে হয়। পরিবেশনের সময় বাটিতে করে চটপটি দেওয়ার পর উপরে আলু ও ডিমের স্লাইস, ধনেপাতা কুঁচি ও মরিচ কুঁচি ও কিছু মশলার গুঁড়া ছিটিয়ে দিতে হয়।
চিত্র ও ঘটনা চটপটি
আরও দেখুন :