Site icon Food & Culinary Arts Gurukul [ খাদ্য ও রন্ধনশিল্প গুরুকুল ] GOLN

মাশরুমের পরিচিতি

মাশরুমের পরিচিতি

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় মাশরুমের পরিচিতি

মাশরুমের পরিচিতি

পরিচিতি ও জাত

মাশরুম একটি পুষ্টিকর সবজি। কিন্তু সাধারণ সবজির মতো মাশরুম মাটিতে জন্মায় না। সবুজ ক্লোরোফিলযুক্ত উদ্ভিদের বৃদ্ধির জন্য যে রকম সূর্যালোকের প্রয়োজন হয় মাশরুমের জন্য তার কোনো প্রয়োজন হয় না। কারণ মাশরুম নিম্নশ্রেণির ছত্রাক জাতীয় পরজীবী উদ্ভিদ। জীবন ধারণের জন্য এরা জৈবিক বস্তু (organic matter) থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি গ্রহণ কারে।

ফলে বিভিন্ন কৃষিজ বর্জ্য অর্থাৎ খড়, কম্পোস্ট, কাঠের গুঁড়া, কাঠ ইত্যাদি নানা জিনিষের ওপর মাশরুম জন্মানো যায়। মাশরুম চাষের জন্য কৃষি জমির প্রয়োজন হয় না। সূর্যালোকের প্রয়োজন হয় না বিধায় ঘরের মধ্যেই বিশেষভাবে প্রস্তুত মাধ্যমে আর্দ্রতাপূর্ন ও সহনশীল তাপমাত্রায় কৃত্রিমভাবে বেশ কিছু জাতের মাশরুম চাষ করা সম্ভব। প্রকৃতিতে অসংখ্য মাশরুম রয়েছে তন্মধ্যে প্রায় ২০০০ মাশরুম ভক্ষণযোগ্য এবং ২০টি চাষ করা সম্ভব হয়েছে।

সভ্যতার কেন্দ্র গ্রীস, রোম, এবং চীনে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তিবর্ধক ও দীর্ঘ জীবনের জন্য মাশরুমকে প্রয়োজনীয় খাদ্য হিসাবে বিবেচনা করা হতো । আর্যরা ভারতে আসার পর ভারতে মাশরুমের প্রচলন শুরু হয়। সে সময় প্রধানত পূজা অর্চনা এবং সোমরস নামক এক ধরনের উত্তেজক পানীয় প্রস্তুতে মাশরুম ব্যবহৃত হতো। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বহু দেশে মাশরুম অত্যন্ত জনপ্রিয় খাবার হলেও বাংলাদেশে এর প্রচলন তেমন হয়নি।

পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়দের মধ্যে মাশরুম একটি জনপ্রিয় খাবার । পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকার বনভূমিতে বিভিন্ন ধরনের মাশরুম প্রাকৃতিকভাবে জন্মায় এবং পাহাড়ি মানুষেরা তা সংগ্রহ করে খায়। গ্রীষ্মের শুরুতে যেখানে পুরানো খড় মাটিতে মিশে রয়েছে কিংবা বনভূমিতে যেখানে মাটিতে প্রচুর পাতা বা কাঠ পড়ে থাকে সে সমস্ত স্থানে খড়ের উপর বা কাঠের গুড়িতে মাশরুম গজায় সাধারনত উই-এর ঢিবির কাছেই মাশরুম জন্মাতে দেখা যায়।

এই জন্য গ্রীষ্মের শুরুতে পাহাড়িরা উই ঢিবির আশে পাশে মাশরুমের খোজ করে। এক জায়গায় প্রতিবছরই মাশরুম দেখা যায়, কারণ যে জায়গায় মাশরুমের মাইসেলিয়াম থাকে সেখান থেকে পরবর্তী বছর সহায়ক পরিবেশে মাশরুম জন্মায়। বর্তমানে বনভূমি সংকুচিত হওয়ার এবং জুম চাষেরে কারণে প্রাকৃতিকভাবে মাশরুমের উৎপাদন কমে যাচ্ছে।

তাছাড়া জনসংখ্যার চাপে মাশরুম ওঠার সাথেই সাথেই তা সংগ্রহ করায় পরিপক্ক মাশরুমের স্পোর বা বীজ ছড়িয়ে যেতে পারে না। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়রা মাশরুমকে ‘ওল’ বলে। এটি তাদের কাছে অত্যন্ত দামী সবজি। বাড়িতে নতুন জামাই বা বড় অতিথি এলে মাশরুম থেকে প্রস্তুত খাবার দিয়ে তাকে আপ্যায়ন করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের বাজারে ভালো সাইজের তাজা মাশরুম ৪০০-৬০০ টাকা কেজি মূল্যে বিক্রয় হয়।

মাশরুম ও ব্যাঙের ছাতা :

মাশরুম হলো এক ধরনের ভক্ষণযোগ্য মৃতজীবী ছত্রাকের ফলন্ত অঙ্গ। ছত্রাকবিদগণ পৃথিবীতে প্রায় তিন লক্ষ প্রজাতির ছাত্রাক চিহ্নিত করতে পেরেছেন। এই অসংখ্য ছত্রাকের মধ্য থেকে দীর্ঘদিন যাচাই ও বাছাই করে যে সমস্ত ছত্রাক সম্পূর্ণ খাওয়ার উপযোগী, পুষ্টিকর ও সুস্বাদু সেগুলোকেই তারা মাশরুম বলে শনাক্ত করেছেন ।

মাশরুমের মতো দেখতে বনে জঙ্গলে অনেক ধরনের ছাতা আকৃতির ছত্রাক জন্ম নেয় সেগুলো খাওয়ার অনুপযোগী এবং বিষাক্ত। কিন্তু চাষ করা মাশরুম কখনই বিষাক্ত হয় না ।

মাশরুমের গঠন :

ছাতার মতো মাশরুমের যে অংশটি আমরা দেখতে পাই একে ছত্রাকের ফ্রুটিং বডি বলে। মাশরুমের ফ্রুটিং বডি বা ফুল কিংবা ভক্ষণযোগ্য অংশকে চার ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:-

১) টুপি বা পিলিয়াস (Pilius )

২) জিল (Gill) বা ল্যামেলি (Lamellac)

৩) আবরন বা ভেইল এনুলাস (Veil Annulus) ও

৪) দণ্ড বা স্টাইপ (Stipe)

টুপি বা পিলিয়াস : এটি অনেকটা ছাতার আকৃতি বিশিষ্ট। এটি সাধারণত মাংশাল এবং পুরু হয়। জাত ভেদে টুপি বিভিন্ন আকৃতি, মাপও বর্ণের হয়। এটি মাশরুমের প্রধান খাওয়ার অংশ ।

জিল : মাশরুমের টুপির নিচের অংশকে জিলে বলে। জিল এক ধরনের অসংখ্য সমান্তরাল সুতা দিয়ে তৈরি এবং এর মধ্যে বংশবিস্তারের অতি প্রয়োজনীয় স্পোর বা বীজ থাকে।

আবরণ : মাশরুমের নতুন ফ্রুটিং বডির জিল এক ধরনের কোষ কলা দ্বারা আবৃত থাকে। এই কোষ কলাকে আবরণ বা ভেইল বলে। ধীরে ধীরে ফ্রুটিং বডি বড় হতে থাকলে এটা ছিঁড়ে যায় এবং দণ্ডের চারদিকে আংটির মতো আকার তৈরি হয়।

 

 

চিত্র : মাশরুমের ফ্রুটিং বডি

দণ্ড বা স্টাইপ : টুপিকে ধরে রাখার জন্য দণ্ড কাজ করে। দণ্ডটি টুপির মাঝে থাকে। দণ্ডটির ভেতরের অংশ ভরাট কিংবা ফাঁপা থাকতে পারে। বিভিন্ন মাশরুমের দণ্ড বিভিন্ন আকৃতির হয়ে থাকে। এগুলো মাশরুম চিনতে সাহায্য করে। মাশরুমের দণ্ড থেকে টুপি পর্যন্ত সম্পূর্ণ অংশই খাওয়া যায়।

মাশরুমের বিভিন্ন জাত :

প্রকৃতিতে মাশরুমের বহু জাত রয়েছে তন্মধ্যে বাংলাদেশে ৮-১০ জাতের মাশরুম বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা যায়। তাপমাত্রা ও আপেক্ষিক আর্দ্রতা মাশরুম চাষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে বাতাসের শতকরা আর্দ্রতা ৬০ ভাগের নিচে নামে না এবং তাপমাত্রার পরিসীমা হচ্ছে ১০-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস । আর্দ্রতা, তাপমাত্রা ও কাঁচামালের প্রাপ্তির ভিত্তিতে নিম্নবর্ণিত মাশরুমের জাতগুলো আমাদের দেশে চাষ করার উপযোগী।

 

 

নিম্নে প্রধান প্রধান মাশরুমের পরিচিতি ও বৈশিষ্ট্য দেয়া হলো-

ঝিনুক বা ওয়েস্টার মাশরুম :

এই মাশরুমটি সারা বিশ্বে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও ঔষধিগুণ সম্পন্ন। এই মাশরুমকে বিশ্বে বিভিন্ন নামে চেনে। এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- ফ্রুটিং বডির বর্ণ সাদা, তুলনামূলকভাবে একটু হালকা ও দেখতে ঝিনুকের মতো। আমাদের দেশে সব পরিবেশে, সব জায়গাতে সারা বছর চাষ করা যায়। ফলন অত্যন্ত ভালো।

 

চিত্র : ওয়েষ্টার বা ঝিনুক মাশরুম

এই মাশরুমটি কাঠের গুঁড়া, ধানের খড়, গমের খড়, আখের ছোবড়া, কাগজ, চায়ের পাতি, সুপারির ছালসহ আরও বহুবিধ Substrate-এর উপর মাশরুম চাষ করা যায়। বিশ্বের বাজারে এর পুষ্টিগুণ, ঔষধিগুণ ও স্বাদের জন্য চাহিদা বহুগুণে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ মাশরুম এর প্রজাতির নাম- Pleurotus Ostreatus.

মিল্কি বা দুধ মাশরুম :

মিল্কি মাশরুম বাংলাদেশের একটি সম্ভাবনাময় মাশরুম। এর পুষ্টিগুণ ও ঔষধিগুণ অত্যন্ত বেশি। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাময় মাশরুম। এর শেলফ লাইফ বেশি বিধায় বিদেশের রপ্তানির জন্য সবচেয়ে উপযোগী। জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ইতালি, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স এ সব দেশে এ মাশরুমের প্রচুর চাহিদা আছে।

বৈশিষ্ট্যঃ

১. এটি উচ্চ তাপমাত্রায় চাষ করা যায়।

২. গ্রীষ্মকালীন মাশরুম।

৩. ধানের খড়, গমের ভুসি, কাঠের গুঁড়া ব্যবহার করে চাষ করা যায়।

৪. সুস্বাদু এবং অল্প খরচে চাষ করা যায় ।

৫. ফ্রুটিং বডি দুধের মতো সাদা এবং আকৃতিতে অনেক বড় হয়।

৬. স্টাইপ অনেক মোটা।

৭. শেলফ লাইফ বেশি বিধায় অনেক দিন সংরক্ষণ করে রাখা যায়।

৮. আমাদের দেশে মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ৮ মাস চাষ করা যায়।

৯. অনুকূল পরিবেশ : তাপমাত্রা : ২৫-৩০ সে: এবং আপেক্ষিক আর্দ্রতা : ৭০-৮০%

 

চিত্র : মিল্কি বা দুধ মাশরুম

বাটন মাশরুম :

Agaricus Bisporus নামের মাশরুমটি বিশ্বে বাটন মাশরুম হিসেবে সর্বাধিক পরিচিতি এবং বিশ্বের মোট মাশরুম উৎপাদনের প্রায় ৪০ শতাংশ মাশরুমই হচ্ছে বাটন মাশরুম। মূলত : শীতপ্রধান দেশে এর চাষাবাদ ভালো হয় বিধায় যুক্তরাষ্ট, নেদারল্যান্ড, পোলান্ড, স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, আয়ারল্যান্ড, কানাডা, যুক্তরাজ্য, চীন ও ভারতে (উত্তরাংশে) এ মাশরুম বেশি উৎপন্ন হয়।

এ মাশরুম উৎপাদনের জন্য নিম্ন তাপমাত্রা ও উচ্চ আর্দ্রতার প্রয়োজন হয় বিধায় আমাদের দেশে শীতকালে প্রাকৃতিক আবহাওয়াকে কাজে লাগিয়ে চাষ করা যায়। তবে উচ্চ ফলনশীল গুনাগুন বজায় রেখে সারা বছর চাষ করতে হলে নিয়ন্ত্রিত পরিশে (Controll Condition)-এ চাষ করতে হবে।

 

চিত্র : বাটন মাশরুম

বৈশিষ্ট্য :

১. এটি ফ্রুটিং বডি বোতাম আকৃতির, মাংসল প্রকৃতির ও সুস্বাদু

২. বর্ণ ক্রিম থেকে ধূসর।

৩. চাষ পদ্ধতি ব্যয়বহুল ।

৪. বাজার মূল্য বেশি।

৫. শীতকালীন মাশরুম।

শীতাকে মাশরুম :

শীতাকে মাশরুম (Shiitake ) বিশ্বের অন্যতম দামি ও চাহিদাসম্পন্ন একটি সবজি মাশরুশ। পুষ্টি ও ঔষধিগুণে ভরা সুস্বাদু এই মাশরুমের উৎপাদন বিশ্বে দিন দিন বেড়েই চলছে। অন্যান্য মাশরুমের চেয়ে স্বাদ ও গন্ধে ভিন্নতা থাকায় বাংলাদেশেও এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। এ মাশরুম চীন, জাপানসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে কাঠের গুঁড়িতে (Wood Log) চাষ করা হয়। এতে সময় ও খরচ অনেক বেশি লাগে।

 

চিত্র : শীতাকে মাশরুম

কিন্তু আমাদের দেশে জাতীয় মাশরুম উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ কেন্দ্র কর্তৃক উদ্ভাবিত সহজ প্রযুক্তিতে চাষ করা হয়। এই পদ্ধতিতে সাবস্ট্রেট হিসেবে কাঠের গুঁড়া (Sawdust) ব্যবহৃত হওয়ায় সময় ও খরচ অনেক কম লাগে। সম্ভাবনাময় এই মাশরুম এ দেশে বাণিজ্যিক আকারে চাষ করা এখন সময়ের দাবি।

খড় বা স্ট্র মাশরুম :

চীনে সর্বপ্রথম স্ট্র মাশরুমের চাষ শুরু হয়। এ কারণে স্ট্র মাশরুম সাধারণত চাইনিজ মাশরুম নামে পরিচিত। স্বাদ ও পুষ্টিগুণের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার এই মাশরুম বেশ জনপ্রিয়। Chang and Miles (১৯৯৩) এর মতে বিশ্বে চাষকৃত মাশরুমের মধ্যে এর অবস্থান তৃতীয়। স্ট্র মূলত গ্রীষ্মকালীন মাশরুম। আমাদের দেশের আবহাওয়া স্ট্র মাশরুম চাষের জন্য উপযোগী।

১৯৭৯ সাল থেকে বাংলাদেশে স্ট্র মাশরুম চাষ শুরু হয়। মূলত বাংলাদেশে মাশরুম চাষের সূচনা হয় স্ট্র মাশরুমের চাষ দিয়ে। বৈজ্ঞানিক নাম : Volverilla volvacea.

 

চিত্র : খড় বা স্ট্র মাশরুম

স্ট্র মাশরুমের সাধারণ বৈশিষ্ট্য :

১. এ মাশরুম দেখতে ধূসর বর্ণের।

২. জীবনচক্র খুব দ্রুত সম্পন্ন হয়।

৩. অন্যান্য মাশরুমের তুলনায় সুস্বাদু, পুষ্টি উপাদান বেশি ও ঔষধিগুণ সম্পন্ন ।

৪. উৎপাদন প্রক্রিয়া সহজ স্বল্প খরচে চায় করা যায়।

৫. দামি যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয় না

৬. স্ট্র মাশরুম চাষের পর সেই উপকরণ ব্যবহার করে পুনরায় ওয়েস্টার ও মিল্কি মাশরুম করা যায়।

৭. অতিরিক্ত গরমে অন্যান্য মাশরুমের যখন উৎপাদন কমে যায় সে সময় স্ট্র ভালো ফলন দেয়। এ কারণে ওয়েস্টার মাশরুমের তুলনায় স্ট্র মাশরুমের জনপ্রিয়তা ও বাজার মূল্য বেশি।

৮. বাংলাদেশে সফলভাবে চাষকৃত মাশরুম হচ্ছে স্ট্র মাশরুম।

আরও দেখুন : 

Exit mobile version