আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় বিভিন্ন প্রকার মশলার ব্যবহার
Table of Contents
বিভিন্ন প্রকার মশলার ব্যবহার
বিভিন্ন প্রকার মশলার ব্যবহার
মশলা ফসলের মধ্যে কোন কোন মশলার উল্লেখযোগ্য পুষ্টিমান থাকলেও এগুলোকে সাধারণত খাদ্যের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার না করে শুধু খাদ্যের স্বাদ ও রং বৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করা হয়। এমতাবস্থায় আমাদের দেশে ব্যবহৃত প্রধান প্রধান মশলার পুষ্টিমান ও ভেষজ পরিচিতি নিম্নে বর্ণনা করা হলো-
মরিচ :
মরিচ বা লঙ্কা অধিকাংশ ব্যঞ্জনের একটি উপাদান। বাংলাদেশে এটি অন্যতম প্রধান মশলা জাতীয় ফসল। মরিচে কেপসেইসিন (Capsaicin) নামক পদার্থের উপস্থিতির কারণে একে ঝাল করে তোলে। মরিচকে ইংরেজিতে চিলি (Chilli) বা পিপার (Pepper) বলা হয়। ব্যবহারের দিক দিয়ে মরিচ দুই প্রকার। যথা- ঝাল মরিচ ও মিষ্টি মরিচ বা ক্যাপসিকাম (Capsicum)। বাংলাদেশি ঝাল মরিচের মধ্যে ছোট মরিচ, বড় মরিচ, পাটনাই, ধানী মরিচ, ঝাল মরিচ, সাহেব মরিচ, সূর্যমুখী ও গোল মরিচ উল্লেখযোগ্য।
মিষ্টি মরিচ সচরাচর আকারে বড়, মোটা ও পুরু মাংসল হয়। আমেরিকায় মিষ্টি মরিচ ও ভারতীয় উপমহাদেশে ঝাল মরিচের ব্যবহার বেশি হয়। মরিচে প্রচুর ভিটামিন-এ ও সি এবং ক্যালসিয়াম আছে।
পেঁয়াজ :
পেঁয়াজ মশলা হলেও একে সবজি হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। উৎপাদন ও ব্যবহারের দিক দিয়ে পেঁয়াজ বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মশলা ফসল। পেঁয়াজে যথেষ্ট পরিমাণে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন সি আছে। পেঁয়াজের ভেষজ গুণ রয়েছে। মাথার খুশকি ও চর্মরোগ নিরাময়ে পেঁয়াজের রস ব্যবহার করা যায়। ঠান্ডাজনিত রোগের ঔষধ হিসেবে পেঁয়াজ কাজ করে থাকে। পেঁয়াজ খাবারে স্বাদ ও ঝাঁঝ বাড়ায়। মিষ্টি জাতীয় খাবার ছাড়া প্রায় সব খাবারে পেঁয়াজ ব্যবহার করা হয়।
রসুন :
পেঁয়াজের সাথে সাথে যে মশলাটির নাম করতে হয় সেটি হলো রসুন। পেঁয়াজের চেয়ে কম ব্যবহৃত হলেও মশলা হিসেবে রসুনের ব্যবহার অপরিহার্য। যে মাছ ও মাংস কিছুটা নষ্ট হয়ে উঠেছে তাতে রাধুনিরা রসুনের ব্যবহার অতি আবশ্যক মনে করে। স্যুপ, আচার, সস, চাটনি ইত্যাদিতে রসুন ব্যবহার হয়। ভেষজ মতে রসুন বলকারক, বাতরোগ, ফুসফুসের রোগ ও হৃদরোগের উপকারী বলে জানা যায়।
উচ্চ রক্তচাপে রসুনের ব্যবহার উপকারী বলে প্রমাণিত হয়েছে। রসুনে রয়েছে এলিলিক সালফাইড যা ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করতে সক্ষম। তবে এই ফল পেতে হলে রসুন কাঁচা খেতে হয়। রসুন ইনফেকশন প্রতিরোধ করে, কোলেস্টেরল কমায়, প্রোস্টেট ক্যান্সার ও হার্টের অসুখ রোধ করে। রসুনে আমিষ, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন সি ও সামান্য লৌহ থাকে ।
আদা :
আদা একটি উৎকৃষ্ট অর্থকরী মশলা। উৎপাদন ও ব্যবহারের দিক দিয়ে আদার গুরুত্ব অনেক বেশি। আন্তর্জাতিক বাজারে এর প্রচুর চাহিদা। মাংস রান্নায় এটি অপরিহার্য। ঘ্রাণ ও ঝাঁঝ আনার জন্য খাবারে আদা ব্যবহার হয়। এছাড়া নানা রকম আচার, চাটনি, কেচাপ, কেক তৈরিতে আদার ব্যবহার হয়। আদা চা একটি উৎকৃষ্ট পানীয়। ভেষজ মতে আদা কফ-নিবারক, হজম শক্তিবর্ধক ও সর্দি কাশিতে ভালো কাজ করে। আদায় ক্যালসিয়াম ও ক্যারোটিন ছাড়াও সামান্য পরিমাণে লৌহ এবং ভিটামিন সি পওয়া যায়।
হলুদ :
আদার পরই মশলা হিসেবে হলুদের নাম পাশাপাশি বলা হয়। বাংলাদেশের এমন কোনো ব্যঞ্জন নেই, যাতে হলুদ ব্যবহার হয় না। খাবারের রঙ বাড়ানোর জন্য হলুদের ব্যবহার এই উপমহাদেশে বেশি হয়। হলুদ খাবারের রঙকে যেমন বাড়িয়ে তোলে তেমনি বাড়িয়ে তোলে খাবারের স্বাদকে। হলুদের ক্রিম বা হলুদ বাটা সৌন্দর্য চর্চায় ব্যবহৃত হয়। নববধূ ও বরের ‘গায়ে হলুদ’ একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান।
ভারতে হলুদ পশম ও রেশম রাঙানোর জন্য ব্যবহার হয়। কথিত আছে মিসরের রানী ক্লিওপেট্রা তার সৌন্দর্য চর্চায় হলুদ ব্যবহার করতেন। আদার মতো হলুদের ও ঔষধি গুণ রয়েছে। হলুদে যথেষ্ট পরিমাণে ক্যালসিয়াম, কিছু লৌহ ও ক্যারোটিন রয়েছে।
ধনিয়া :
ধনিয়া বাংলাদেশের বহুল ব্যবহৃত মশলা। এর পাতা ও দানা উভয়েই রান্নায় ব্যবহার হয়। এর ব্যবহার খাবারে সুঘ্রাণ যুক্ত করে। তাই খাবারের বৈচিত্র্য আনার জন্য ধনিয়া ব্যবহার হয়ে থাকে। তবে নিরামিষ জাতীয় খাবারেই মূলত ধনিয়া ব্যবহার হয়। আর আচারে ধনিয়া সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়। উল্লেখযোগ্য মশলা ‘পাঁচফোড়ন’ এর অন্যতম উপাদান হচ্ছে ধনিয়া। শীতকালে প্রায় সবধরনের রন্ধনে ধনিয়া পাতা ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
অন্যান্য মসলা
জিরা :
গরম মশলার একটি অন্যতম উপাদান জিরা। জিরা খাবারের রং, স্বাদ ও ঘ্রাণ বৃদ্ধি করে। জিরা নানা ধরনের খাবারে ব্যবহার করা হয়। আমাদের দেশে কিছু খাবার আছে যেগুলো জিরা ছাড়া একেবারেই স্বাদহীন। দুই ধরনের জিরা খাদ্যে ব্যবহার হয়। যথা- কিউমিন বা জিরা, যা দেখতে অনেকটা সাদা, দ্বিতীয়টা শা-জিরা বা ক্যারাওয়ে, যা আকৃতিতে জিরা হতে বড়। ভারত ও ইরানে সর্বাধিক পরিমাণে জিরা উৎপন্ন হয়।
গোল মরিচ :
গোল মরিচও গরম মশলার একটি প্রধান উপকরণ। গোল মরিচ গাছ পান গাছের মতো লতানে উদ্ভিদ। খাদ্য রান্নায়, মাংস ও অন্যান্য খাদ্যের প্রিজারভেটিভ হিসাবে এটি ব্যবহার হয়। এছাড়া ক্যানিং, আচার, বেকারি ও পানীয় শিল্পে ব্যাপকভাবে ব্যবহার হয়। গোলমরিচের ঝাঁঝ ও ঘ্রাণ খাদ্যকে আকর্ষণীয় করে তোলে। অতি প্রাচীন কাল হতে এটি হাড় ভাঙা, মচকানো, ম্যালেরিয়া কম্পন ইত্যাদি রোগের ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগাম ও সিলেট অঞ্চলে সীমিত আকারে গোল মরিচের চাষ হচ্ছে।
দারুচিনি :
এটিও গরম মশলার অন্যতম একটি মশলা। খাবারের ঘ্রাণ বৃদ্ধি করার জন্য এটি ব্যবহার হয়। দারুচিনি গাছের ছাল বা বাকল শুকিয়ে তৈরি হয় বিধায় এটি ব্যতিক্রম মশলা। অনেকে মুখের দুর্গন্ধ দূর করার জন্য খেয়ে থাকেন। দারুচিনির ব্যবহার সর্বপ্রথম শ্রীলংকায় তারপর তা মিশর ও চীন হয়ে ক্রমান্বয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। দারুচিনির তেল (সিন্নানিক তেল) খাদ্য, ওষুধ ও প্রসাধনী শিল্পে ব্যবহার হয়। গাছটি বাগানের শোভাবর্ধক। দারুচিনি পোলাও, বিরিয়ানি, মাংস ভুনা, জর্দাসহ বিভিন্ন খাদ্যে ব্যবহার করা হয়।
এলাচ :
গরম মশলার মধ্যে এলাচ দানা অন্যতম। এলাচ খাবারে সুঘ্রাণ এবং স্বাদ আনার জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এলাচ মিষ্টি বা ঝাল, মুখরোচক অধিকাংশ খাবার তৈরিতে ব্যবহার হয়। এলাচ দানাদার মসলা, এর উৎপাদন বেশি হয় ভারতে তারপর মালয়েশিয়া হয়ে সারা বিশ্বে এটি ছড়িয়ে পড়চে। এলাচ দুই ধরনের বড় এলাচ ও ছোট এলাচ ও সুগন্ধি বিদেশ হতে আমদানি করতে হয়।
তেজপাতা :
মশলার মধ্যে পাতাজাতীয় মসলা হচ্ছে তেজপাতা। এই পাতা শুকনা অবস্থায় খাবারে ঘ্রাণের জন্য ব্যবহার হয়। টক ঝাল মিষ্টি সব খাবারেই তেজপাতা ব্যবহার হয়। তেজপাতা হতে উৎপন্ন সুগন্ধি তেল যা প্রসাধনী ও ওষুধে ব্যবহার হয়। খাবার মশলা হিসেবে তেজপাতার ব্যবহার গ্রীসে শুরু হয়। তারপর রোম হয়ে ক্রমান্বয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
আরও দেখুন :