আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় ধান থেকে মুড়ি, চিড়া ও খৈ তৈরি
Table of Contents
ধান থেকে মুড়ি, চিড়া ও খৈ তৈরি
ধান থেকে মুড়ি, চিড়া ও খৈ তৈরি
ভূমিকা:
ধান বাছাই, মাড়াই ও ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে ঠাণ্ডা করে বস্তায় সংরক্ষণ করা হয়। অতঃপর তা সিদ্ধ করে পুনরায় শুকিয়ে মিলিং মেশিনে খোসা আলাদা করে চাল তৈরি করা হয়। এই চাল রান্না করার পর ভাত তৈরি হয়। ভাত আমাদের দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য।
ধান থেকে আমরা সাধারণত চিড়া, মুড়ি ও খৈ তৈরি করে থাকি। চিড়া মুড়ি, খৈ ২-৩ মাস সংরক্ষণ করা যায়। মুড়ি বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। শিশু, কিশোর, যুবা এবং বয়স্ক সকলেই মুড়ি খেতে ভালোবাসে। গুড়, মুড়ি, চিড়া খৈ এখনও গ্রামে সকালের নাস্তা বা জলখাবার হিসেবে ব্যবহার হয়।
ইদানীং শহরে ঝালমুড়ি, চানাচুরের সাথে মুড়ি, মিষ্টি মুড়ি, মুড়ির মোয়া হিসেবে মুড়ির ব্যবহারের শেষ নেই। দূরের রাস্তায় চিড়া, মুড়ি ও খৈ সঙ্গে নেয়া খুবই সুবিধাজনক। বর্ষাকালে মুড়ি পেঁয়াজ, মরিচ ও তেল দিয়ে ভেজে আকর্ষণীয় মজাদার নাস্তা তৈরি করে নিজে বা মেহমানদের আপ্যায়ন করা যায়। চিড়া, মুড়ি ও খৈ-এর পুষ্টিমূল্য চালের মতো।
পেকেটজাত ঝালমুড়ি বর্তমানে শিল্প পণ্য। তাছাড়া মুড়ি ও চিড়ার তৈরি মোয়া বিক্রি বর্তমানে এক শ্রেণির লোকের পেশা হয়ে দাড়িয়েছে।
মুড়ি (Puffed Rice) তৈরি পদ্ধতি :
দুইভাবে মুড়ি-তৈরি করা যায় যথা :-
১। দেশি বা সানতন পদ্ধতি
২। আধুনিক যান্ত্রিক পদ্ধতি
দেশি বা সানতন পদ্ধতি :
মালা বা বিরই বা স্থানীয় জাতের আমন ধানের চাল থেকে মুড়ি তৈরি করা হয়। মুড়ি তৈরির ধান মোটা বা বড় এবং পরিপক্ব ও পরিষ্কার হলে ভাল হয়। পোকামাকড়ের আক্রমণ যুক্ত হলে মুড়ির মান কমে যাবে। তাছাড়া ধানে ধুলাবালি থাকলে মুড়ি খাওয়ার অনুপযোগী হবে। মুড়ির জন্য ধান নির্দিষ্ট পরিমাপে মেপে সসপ্যানে বা মাটির পাত্রে নিতে হয়।
ধান অল্প সিদ্ধ করার জন্য সসপ্যানে নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি দিয়ে ৭০°C তাপমাত্রায় ২০ মিনিটকাল তাপ দিতে হয়। এই অল্প সিদ্ধ ধান চুলা থেকে নামিয়ে সসপ্যানের গরম পানিসহ প্রায় ১২ ঘণ্টা বা ১ রাত ভিজিয়ে রাখতে হয়। ভিজিয়ে রাখার পর ভিজানো ধান বাঁশের ডালায় উঠায়ে পানি ঝরিয়ে নিতে হবে। এরপর কিছু পানি দিয়ে ধান আবার চুলায় সিদ্ধ করতে হয়।
ধান যখন ২/১টা ফাটতে শুরু করবে তখন বুঝতে হবে যে ধান মুড়ি তৈরির উপযোগী সিদ্ধ হয়েছে। এভাবে সিদ্ধ করা ধান চুলা থেকে নামিয়ে পানি ঝরিয়ে, ঠাণ্ডা করে ৩-৪ ঘণ্টা শুকায়ে নিতে হয়। ধান এমন ভাবে শুকাতে হবে যাতে ধানে শতকরা ১৮-২০ ভাগ আর্দ্রতা থাকে। এ অবস্থা বোঝার জন্য কয়েকটি ধান হাতের তালুতে নিয়ে ঘষা দিলে চাল বের হবে।
এ চাল দাঁতের নিচ দিয়ে চিবুলে কিছুটা শক্ত লাগবে ও মৃদু শব্দ হয়। এরূপ শুকনা ধান ঠাণ্ডা করে গাইলে বা ঢেঁকিতে বা মিলে ভাঙ্গা হয়। ধান ভাঙানোর পর চাল পরিষ্কার করে ঝেড়ে নিতে হয়। চালের গায়ে গুঁড়া লেগে থাকলে মোটা কাপড় বা চটের উপর রেখে ঘষে তা মুছে পরিষ্কার করে নিতে হয়।
মুড়ি তৈরির জন্য দুই মুখওয়ালা চুলা হলে ভালো হয়। তবে এক মুখওয়ালা চুলাও চলবে। বড় মুখওয়ালা দুইটি পাতিল নিত হবে। একটি বড় অপরটি ছোট। ছোট পাতিলে চাল ও বড় পাতিলে বালু জ্বাল দিতে হয়। চাল গরম হলে চিকন কাঠির তৈরি নাড়ুনি দিয়ে ভাজার মতো করে চাল নাড়তে হয়। চাল নাড়ার সময় চালের সাথে ১-২ টেবিল চামচ লবণের দ্রবণ (৩০ ভাগ লবণ ও ৭০ ভাগ পানি) মিশাতে হয়।
গরম চাল নাড়তে নাড়তে লবণ পানি শুকিয়ে যায় এবং ২/৩ টা চাল পুট পুট শব্দ করে ফুটতে থাকবে। বড় পাতিলে বালু গরম হয়েছে কি না তা পরীক্ষা করে নিতে হয়। এ জন্য এক টুকরা পাটখড়ি ভেঙে আগার অংশ গরম বালিতে চেপে ধরলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কালো হয় বা পুড়ে ধোঁয়া ওঠে কী না তা দেখতে হয়।
যদি পাটখড়ির আগা কালো হয় তাহলে বুঝতে হবে যে বালু মুড়ি ভাজার উপযোগী হয়েছে। ২/১ টা ফোঁটা অবস্থায় সমস্ত চাল গরম বালুর মধ্যে ঢেলে দিতে হয়। বালুর মধ্যে চাল ঢেলে দিয়ে চিমটা দিয়ে বালুর পাতিল ধরে ঝাঁকিয়ে চাল ওলট-পালট করতে হয়। বালুসহ পাতিল ২/১ বার ঝাঁকিয়ে ২/৩ বার ওলট-পালট করতে হয়।
তাতে সব চাল ফুটে মুড়িতে পরিণত হয়। চাল ফুটে মুড়ি হলেই সাথে সাথে বালি মিশ্রিত মুড়ি ঝাঁঝরিতে ঢেলে দিয়ে নাড়াচাড়া করলে বালু আলাদা হয়ে নিচে পড়ে যাবে। এরপর ঝাঁঝরির মুড়ি আরও নাড়াচাড়া করলে ঝাঁঝরির ছিদ্র দিয়ে সমস্ত বালু বের হয়ে যাবে।
চিত্রা : মুড়ি ও মুড়ির মোয়া
মুড়ি তৈরি হওয়ার পর পরিষ্কার শুকনা ও জীবাণুমুক্ত জায়গায় রেখে মুড়ি ঠাণ্ডা করতে হয়। তারপর এ মুড়ি দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণ করতে হয়। মুড়ি সংরক্ষণের জন্য জীবাণুমুক্ত শুকনা, পরিষ্কার এবং গন্ধবিহীন টিনের কৌটা বা পলিথিন ব্যাগে রাখা যেতে পারে। তবে মুড়ি ভর্তি করার পর তা বায়ুরোধী অবস্থায় সংরক্ষণ করতে হয়।
আধুনিক বা যান্ত্রিক পদ্ধতি :
যান্ত্রিক পদ্ধতিতে বা অটোমেশিনে মুড়ি করার জন্য দিনাজপুর, পাঁচবিবি জয়পুরহাট, নওগাঁ ও শেরপুর থেকে বি.আর-১১ জাতের আমন ধানের চাল সংগ্রহ করা হয়। মাঝারি মোটা চাল সংগ্রহ করে গুদামজাত করা হয়।
মুড়ি তৈরির পদ্ধতি :
মুড়ি তৈরির কারখানায় দুইটি অংশ থাকে এক টিকে ডায়াল ও অপরটিকে রোস্টার বলে। ডায়ালে এক সিরিয়ালে ১৫-২০টি অ্যালুমিনিয়াম কোটেড লোহার পাতিলে হাতল লাগানো থাকে।
প্রত্যেকটি পাতিলে গ্যাস লাইন সংযুক্ত থাকে। চুলা চালু করে প্রতিটি পাতিলে ৫০ কেজি চাল ঢালা হয় এরপর ১ মগ লবণ পানি (১ লিটার) প্রতিটি পাতিলের চালের সাথে ১৫ মিনিট ধরে হাতল ঘুরিয়ে মিশানো হয়। অতঃপর ৪৫ মিনিট জ্বাল দিতে হয় (বালু ছাড়া)।
১ ঘণ্টা পর চাল মুড়ি হবার উপযোগী হলে বোলে করে হাতে হাতে চাল তুলে হপার দিয়ে রোষ্টারের ভিতরে প্রবেশ করানো হয়। রোষ্টারের ভিতরে গরম বালু অটোমেটিক ঘুরতে থাকে এবং এক মিনিটের মধ্যে মুড়ি তৈরি হয়ে বের হয়ে আসে। ছাঁকনি দিয়ে বালু ও মুড়ি মেশিনেই আলাদা করা হয়। মুড়িকে ব্লোয়ারের মাধ্যমে নির্দিষ্ট স্থানে সংরক্ষণ করা হয়।
আরও দেখুন :