আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় আখের রস নিষ্কাশনের বিভিন্ন ধাপ
Table of Contents
আখের রস নিষ্কাশনের বিভিন্ন ধাপ
আখের রস নিষ্কাশনের বিভিন্ন ধাপ
আখের কর্তন :
আখ কাটার পর পরই মাড়াই করা উচিত। মাড়াইয়ের জন্য মাঠে দাড়ানো অবস্থা থেকেই পোকা ও রোগাক্রান্ত আখ বাদ দিয়ে কাটতে হয়। আখ কাটার সময় দা বা হাঁসুয়া দিয়ে কাটলে আখে প্রায় ৮-১০ ভাগ মাটির নিচে থেকে য়ায়। তাই দা বা হাঁসুয়া দিয়ে আখ কাটা উচিত নয়। ধারালো কোদাল দিয়ে মাটির সমতলে বা সম্ভব হলে একটু মাটির গভীরেই আখের গোড়া কাটা উচিত।
আখ কাটার পর পাতা না ছাড়িয়েই মাড়াই স্থানে আনা উচিত। তাতে আখ শুকায় না। তবে আখ মাড়াইয়ের পূর্বে পাতা ছাড়িয়ে সম্ভব হলে পরিষ্কার করে নেওয়া প্রয়োজন। কেননা তাতে আখের রসে ময়লা বা গাদের পরিমাণ কমে যাবে। রস নিষ্কাশন পদ্ধতি বা মাড়াই আমাদের দেশে আখ থেকে রস নিষ্কাশন পদ্ধতি দুই ধরনের। যথা-
পাঁচ রোলার বিশিষ্ট মাড়াই কল:
এটি ৫ রোলার বিশিষ্ট ও দুই স্তরে আঁখ মাড়াই উপযোগী কল। এই কলে বর্তমানে প্রচলিত অন্যান্য মাড়াইকল থেকে শতকরা ১০-১৫ ভাগ বেশি রস আহরণের ক্ষমতাসম্পন্ন। মাড়াই কলটি একটি ৪ ঢাকা বিশিষ্ট ১২ ফুট লম্বা ও ৩.৫ ফুট চওড়া মজবুত লোহার ফ্রেমের উপর স্থাপিত। এই মাড়াই কলে ঘণ্টায় ৫০০-৫৬০ কেজি আখ মাড়াই করা হয়। অনেক সময় ও রোলার বিশিষ্ট মাড়াইকল ও ব্যবহার হয়ে থাকে।
চিত্র : পাঁচ রোলার বিশিষ্ট আখ ভাঙার মেশিন
যান্ত্রিক পদ্ধতি রস আহরণ :
এ পদ্ধতিতে মাড়াই করার জন্য আখ চলমান কনভেয়ার এ ফেলে দেওয়া হয়। আখগুলো যেতে যেতে ঘূর্ণায়মান ছুরির সাহায্যে কেটে টুকরা টুকরা করা হয়। পরে ঐ টুকরাগুলো থেকে পেষণযন্ত্রের সাহায্যে রস বের করা হয়। চিনি তৈরির জন্য এই যান্ত্রিক পদ্ধতিতে রস আহরণ করা হয় এবং আহরণের পরিমাণ ৮০-৮৫ ভাগ ।
আখের রস থেকে গুড় উৎপাদন
আখ, খেজুর বা তাল গাছের শোধিত বা অশোধিত রস থেকে উৎপাদিত ঘনীভূত তরল বা কঠিন পদার্থকে গুড় বলে। মিঠাই, সন্দেশ, মণ্ডা ও পিঠা তৈরিতে গুড়ের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। গ্রামে আখ চাষিরা নিপুণ কারিগর দিয়ে স্বল্প পরিমাণ গুড় তৈরি করে থাকেন। গুড় উৎপাদন তিনটি ধাপে করা হয়ে থাকে। যথা-
১. রস নিষ্কাশন : এ পদ্ধতি পূর্বেই বর্ণনা করা হয়েছে।
২. রস পরিষ্কারকরণ : রস পরিষ্কারকরণের উদ্দেশ্য হলো গুড় থেকে আনাকাঙ্খিত দ্রব্যাদি অপসারণ, গুড়ের রং সুন্দর করা, গুড়কে কঠিন করা ও গুড়ে চিনি ছাড়া অন্যান্য পদার্থের উপস্থিতি রোধ করা। এজন্য কিছু জৈব ও অজৈব পরিষ্কারক পদার্থ ব্যবহার করা হয়। যেমন-
ক) জৈব বা উদ্ভিদজাত পরিষ্কারক :
১. ঢেঁড়স গাছের কাণ্ডের নিচের অংশ ও শিকড় পিষে যে বিজল পদার্থ পাওয়া যায় তা যারা রস পরিষ্কার করা যায়।
২. মান্দার ও শিমুল গাছের রস একাজে ব্যবহার করা যায়।
৩. ঘৃতকাঞ্চন বা ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরার নির্যাস প্রতি কেজি রসে ১০-১৫ গ্রাম বা ১ কড়াই অর্থাৎ ২০০-২৪০ কেজি রসে ২-২.৫ কেজি হারে ব্যবহার করা হয়। ঘৃতকুমারীর ছাল তুলে ভিতরের নির্যাস বের করে ফুটন্ত রসে ব্যবহার করতে হবে।
খ) অজৈব বা রাসায়নিক পরিষ্কারকারক :
১. সাধারণত ১ কেজি রসের সাথে ১ গ্রাম চুনের পানি মিশিয়ে গুড় শক্ত ও পরিষ্কার করা যায়।
২. গুড় দীর্ঘদিন সংরক্ষণ ও পরিষ্কার করার জন্য সোডিয়াম বাই কার্বনেট ব্যবহার করা যায়।
৩. সোডিয়াম বাই কার্বনেটের পরিবর্তে পরিষ্কার সোডিয়াম কার্বনেট, সোডিয়াম সালফেট ও সোডিয়াম ক্লোরাইডের (৬০৪৬.৪৪৪.৫) সমন্বয়ে গঠিত সাজ্জি ও ব্যবহার করা য়ায়।
৪. গুড়ের রং উজ্জ্বল করার জন্য হাইড্রোজ ব্যবহার করা হয়। তবে এর বেশি ব্যবহার ক্ষতিকারক।
৫. গুড় শক্ত না করে তরল গুড় তৈরির জন্য ফিটকিরি ব্যবহার হয়।
৬. গুড়ে ৭০ পিপিএম এর বেশি সালফার ডাই-অক্সাইড থাকলে তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর
রস জাল প্রক্রিয়া :
বড় কড়াইতে রস জ্বাল দিতে হয়। কড়াইয়ের মাপ ১৮০ সে.মি. লম্বা, ৯০ সে.মি. প্রস্থ, ১৫ সেমি. উচ্চতা হয়। জ্বাল দিলে প্রচুর পরিমানে গাঁদ ভেসে ওঠে যা দ্রুত হাতা দিয়ে সরিয়ে ফেলতে হয় । এর পর ভেষজ নির্যাস ব্যবহার করতে হয়। এই গাদ গরু ও মহিষের ভালো খাবার হিসেবে ব্যবহার হয়।
রস খনীভূতকরন :
ভেষজ নির্যাসে প্রচুর পরিমাণে ভেজিটেবল প্রোটিন আছে, যা উত্তপ্ত রসে ঢেলে দিলে জমাটবদ্ধ হয়ে আশেপাশের ময়লা-আবর্জনাকে আটকিয়ে ধরে গাদে পরিণত করে ভেসে ওঠে। হাতা দিয়ে এই ময়লা গাদ ফেলে দিতে হবে, এতে রস স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে অধিকতর স্বচ্ছ রসে পরিণত হয় এবং গুড়ের মান বৃদ্ধি পায়। গাদ সরিয়ে ফেলতে বেশি দেরি হলে রসের সহিত মিশে জটিল অপরিশোধন যোগ্য হয়ে পড়ে এবং গুড়ের ক্ষতি হয়। রস ঘনীভূত হবার সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা বেড়ে যায় ।
গুড় তৈরি :
এমতবস্থায় হাতার সাহায্যে কড়াইয়ের ফুটন্ত ঘনীভূত রস লাগাতারভাবে নাড়তে হবে এবং চুলার তাপ কমিয়ে ফেলতে হবে। ফুটন্ত ঘনীভূত রস সিরাপের ন্যায় হলে চুলা থেকে কখন নামানো উচিত তা নির্ধারণের জন্য হাতার সাহায্যে যৎসামান্য ঘনীভূত রস পরিষ্কার ঠাণ্ডা পানির মধ্যে ছেড়ে দিতে হবে। যদি তা দ্রুত জমাট বাঁধে এবং পানিতে ছড়িয়ে না যায় তা হলে বুঝতে হবে গুড় চুলা থেকে নামানোর জন্য উপযোগী হয়েছে এ সময় রসের তাপমাত্রা ১১০-১০৫°০ এ উন্নীত হয়।
এ সময়ে ১০০ লিটার রসে ২০মি.লি নারিকেল তেল মিশালে রস ফেটে যায় না ও লেগে যায় না। গুড়ের দানার আকার ও আকৃতি ভালো হয়। কড়াই চুলা থেকে দ্রুত নামিয়ে কিছুটা ঠাণ্ডা করে চাহিদামতো কাঠের বা পোড়া ছাঁচে ঘনীভূত ঐ রস ঢালতে হবে। এ অবস্থায় কিছুক্ষণ রেখে দিলেই রস ঠাণ্ডা হয়ে জমাট বেঁধে যাবে এবং তা গুড় হিসাবে বিক্রি অথবা সংরক্ষণ করা যাবে।
উন্নতমানের গুড়ের বৈশিষ্ট্য :
১. গুড়ের রং হালকা ও এর কাঠিন্যতা বেশি হতে হবে।
২. গুড় বেশি দানাদার হবে।
৩. এর স্বাদ মিষ্টি ও উত্তম গন্ধ থাকতে হবে।
৪. গুড়ের দীর্ঘদিন সংরক্ষণ ক্ষমতা থাকতে হবে।
তবে গুড়ের গুণগত মান নির্ভর করে আখের রসের মিশ্রণ, রস জ্বাল দেয়ার পদ্ধতি, রস পরিষ্কার করার জন্য ব্যবহৃত উপাদানের ব্যবহারের উপর।
আখ থেকে চিনি উৎপাদন :
মাড়াইযোগ্য আখকে প্রথমে চিনি কলের ঘূর্ণায়মান ছুরির সাহায্যে টুকরা টুকরা করে কাটা হয়। পরে ওই টুকরাগুলোকে পেষন করে রস বের করা হয়। তবে অবশিষ্ট আখের ছোবড়ায় (১- ৩%) চিনি থেকে য়ায়। তাই আরো বেশি পরিমাণ চিনি আহরণের জন্য ছোবড়ায় উপর পানি সিঞ্চন করে বার বার পেষণ করা হয়। পাতলা কাপড়ের সাহায্যে রস ছেঁকে নিতে হয়।
আখের রস কিছুটা অম্ল স্বাদযুক্ত এবং এতে গন্ধক, চুন যোগ করা হয়। ফলে সমস্ত অবাঞ্ছিত দ্রব্য থিতিয়ে পড়ে এবং দানা তৈরিতে সুবিধা হয়। পরে পরিষ্কার ও পরিশোধিত রস থেকে ধাপে ধাপে বিভিন্ন মেশিনের সাহায্যে চিনি তৈরি করা হয়।আখ থেকে চিনি উৎপাদনের ফ্লোচার্ট –
আইসিং সুগার :
কনফেকশনারির খাবার প্রস্তুতের জন্য মেশিনে একপ্রকার গুঁড়া চিনি তৈরি হয়। একেই আইসিং সুগার বলে।
ব্রাউন সুগার :
অশোধিত বাদামি রং এর চিনিকে ব্রাউন সুগার বলে। এটি বিদেশে পাওয়া যায় । আমাদের দেশের চিনি কলসমূহে আইসিং সুগার ও ব্রাউন সুগার তৈরি ও বাজারজাতকরণের কোনো ব্যবস্থা নেই।
আরও দেখুন :