আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় নারিকেল থেকে উৎপাদিত বিভিন্ন খাদ্য ও অন্যান্য দ্রব্য
Table of Contents
নারিকেল থেকে উৎপাদিত বিভিন্ন খাদ্য ও অন্যান্য দ্রব্য
নারিকেল থেকে উৎপাদিত বিভিন্ন খাদ্য ও অন্যান্য দ্রব্য
নারিকেলের গাছের ব্যবহার বহুবিধ। এর প্রতিটি অংশ মানুষের কাজে লাগে। খাদ্য, পানীয় ও নির্মাণসামগ্রী এবং শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহকারী হিসেবে নারিকেল বিখ্যাত। কাজেই নারিকেল যেমন খাদ্য তেমনই আঁশের ফসল ও তেলবীজও বটে। নারিকেল গাছ ও ফলের উৎপন্ন দ্রব্যাদি মোটামুটিভাবে তিন ভাগে ভাগ করা যায় যেমন-
ক) খাদ্য দ্রব্য
১) নারিকেল শাঁস বা কার্নেল।
২) নারিকেলের আমিষ ও ভোজ্য তেল।
৩) নারিকেলের শুকনো শাঁস ।
৪) নারিকেলের ময়দা বা খৈল ।
৫) বল ও কাপ কোপরা ।
৬) শুকানো কোরা নারিকেল।
৭) নারিকেলের পানি ।
৮) তাড়ি ও তাড়িজাত দ্রব্য ।
খ) বাণিজ্যিক ও শিল্পজাত দ্রব্য :
১) কোপরা ।
২) তৈল।
৩) নারিকেল খৈল ।
৪) ছোবড়া বা Coir
৫) ছোবড়ার গুঁড়া
গ) নির্মাণসামগ্রী :
১) পাতা
২) নারিকেলের মালা
৩) কাঠ কয়লা (Shell Charcol
৪) মালার গুঁড়া
৫) নারিকেল গাছের কাঠ
খাদ্যদ্রব্য :
নারিকেল উৎপাদনকারী দেশসমূহে নারিকেল একটি উৎকৃষ্ট খাদ্য হিসেবে সুপরিচিত। নারিকেলের খাদ্য দ্রব্যগুলো নিম্নরূপ-
শাঁস বা কার্নেল :
সুপরিপক্ব হওয়ার আগে নারিকেলের নরম শাঁস অনেকের কাছে বেশ প্রিয়। তবে শাঁস হিসেবে সাধারণত পরিপক্ব নারিকেলের শাঁসকেই ব্যবহার করা হয়। কাঁচা শাঁস থেকে বিভিন্ন ধরনের পিঠা পায়েস, নাড়ু-লাড্ডু তৈরি করার রীতি এদেশে বহুল প্রচলিত কাঁচা শাঁস থেকে যে দুধ পাওয়া যায় তা বিভিন্ন প্রকার খাদ্যসামগ্রী তৈরি ও সরাসরি পানীয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
নারিকেলের দুধ :
টাটকা শাঁস নারিকেল কুরানি দিয়ে কুরে তার সাথে হালকা গরম পানি মিশিয়ে ব্লেন্ডারে ব্লেন্ডিং করে যে সাদা রস বের হয় তা ছেঁকে যে পানীয় পাওয়া যায় তাহাই নারিকেলের দুধ। ফিলিপাইনে নারিকেলের দুধ থেকে সিরাপ প্রস্তুত করা হয় এবং কনফেকশনারিতে ব্যবহার হয়। দুধের মধ্যে গড়ে ৫০% পানি, ৪০% স্নেহ, ২.৫% আমিষ, ৩% শ্বেতসার, ১০% কঠিন পদার্থ ও ১- ২% খনিজ লবণ থাকে।
চিত্র : নারিকেল থেকে দুধ আহরণ
আমিষ :
নারিকেল শাঁসের ৪-৪.৬% আমিষ থাকে। নারিকেল শাঁস থেকে ভোজ্য আমিষ, তৈল, ময়দা তৈরির পদ্ধতি উদ্ভাবন ও চালু পৃথিবীর কোনো কোনো দেশে সম্ভব হয়েছে।
ডাবের পানি :
কচি ডাবের পানি দেহকে সতেজ রাখার জন্য অনেকেই খেয়ে থাকেন। বিভিন্ন রকম পেটের পীড়ায় গ্লুকোজ, স্যালাইনের বিকল্প হিসেবে ডাবের পানি খুবই উপকারী। পাতলা পায়খানা বা বমির ফলে দেহে যে পরিমাণ পানির অভাব ঘটে তা পূরণে ডাবের পানি অত্যন্ত কার্যকরি। ঘরে তৈরি স্যালাইনের চেয়ে ডাবের পানি স্যালাইন হিসেবে অধিক কার্যকরী।
তাড়ি বা Toddy :
অফুটা ফুলের ছড়া বা পুষ্প মঞ্জরীর মোচা ধারালো ছুরি দ্বারা কেটে বিশেষ প্রক্রিয়ায় মিষ্টি রস সংগ্রহ করা হয়। নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এ রস গাজানোর পর যে তরল পদার্থ পাওয়া যায় তাকে তাড়ি বলে। একটি সতেজ গাছ থেকে প্রতিদিন ২-২.৫ লিটার রস হিসেবে বছরে ২০০-৪০০ লিটার রস পাওয়া যায়। প্রতিটি ছড়া থেকে ১.৫-২ মাস রস সংগ্রহ করা যায়। প্রতি ১০০ গ্রাম রসে ১২-১৫ গ্রাম চিনি পাওয়া যায়। রসকে গাঁজিয়ে ও পরিশ্রুত করার পর অ্যালকোহল তৈরি হয়। প্রায় ৭ গ্যালন রস থেকে ১ গ্যালন এলকোহল পাওয়া যায় । রস টাটকা অবস্থায় পান করা ছাড়াও শুঁড়, চিনি, সিরকা ইত্যাদি তৈরি করা যায়
বাণিজ্যিক পণ্য :
কোথা (Copra) :
নারিকেলের আস্ত বা খণ্ডিত শুকানো শাঁসকে কোথা বলে। আন্তর্জাতিক বাজারে কোপ্রা আকারেই সর্বাধিক নারিকেল বেচাকেনা করা হয়। কোথা দুই ধরনের, যথা- বল কোথা ও কাপ কোথা। আস্ত নারিকেলে বিশেষ ধরনের গুদামে রেখে ৮-১২ মাস শুকালে শাঁস শুকিয়ে সংকুচিত হয়ে খোল থেকে আলাদা হয়ে যায়। একেই বল কোথা বলে। কিন্তু খোলসহ শাঁস দিখন্ডিত করে রোদে বা চুল্লিতে শুকিয়ে কাপ কোথা তৈরি করা যায়। কোপাতে ৫-৭% পানি, ২০-২৫% আমিষ থাকে।
চিত্রঃ বল ও কাপ কোপা
প্রধানত : তেল উৎপাদনের জন্য কোগ্রা ব্যবহার হয়। তবে কুরিয়ে খাদ্যের উপাদান হিসেবেও ব্যবহার হয়। সাধারণত ১০০০টি মাঝারি আকারের নারিকেল থেকে ২০০-৩০০ কেজি কোথা পাওয়া যায় ।
নারিকেল তেল :
কোপাকে গুঁড়া করে ঘানি, হাইড্রোলিক প্রেস অথবা এক্সপেলার মেশিনের সাহায্যে তেল আলাদা করা হয়। কোন কোন সময় দ্রাবক (Hexane, Benzene) নিষ্কাশনের সাহায্যেও তেল আলাদা করা হয়ে থাকে। ঘানি ব্যবহার করলে খৈলে ১২-১৭% তেল থেকে যায়। এক্সপেলারের বেলায় কম বেশি ৬% তেল থাকে কিন্তু দ্রাবক ব্যবহার করলে তেলের প্রায় সবটাই বের হয়ে আসে।
নারিকেল তেল একটি উৎকৃষ্ট ভোজ্যতেল হিসেবে রান্নায় ব্যবহার করা যায়। তবে আমাদের দেশে রান্নার চেয়ে চুলে মাখার কাজেই তেল বেশি ব্যবহৃত হয়। এছাড়া সাবান, প্রসাধনী, লুব্রিকেন্ট প্রভৃতি তৈরিতে এ তেল ব্যবহৃত হতো।
শুকনা কুরা নারিকেল :
শাঁস কুরে শুকিয়ে এটা তৈরি করা হয়। কোথার ন্যায় এটাও প্রচুর পরিমাণে রপ্তানি হয়। শ্রীলংকা ও ফিলিপাইন প্রধান রপ্তানিকারক দেশ। ইহাতে ২-২.৫% পানি থাকে এ দ্রব্য সরাসরি বিস্কুট ও বেকারি দ্রব্যে ব্যবহৃত হয়। কুরানোর সময় বিভিন্ন সাইজে কুরিয়ে জীবাণুমুক্ত পরিবেশে প্যাকিং করা হয়।
চিত্র : কোরানো নারিকেল ।
নারিকেলে খৈল :
কোথা থেকে তেল নিষ্কাশনের পর যে খৈল থাকে তা পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। নারিকেলের খৈল গরু ও ছাগলের উত্তম খাদ্য। এছাড়াও এ খৈল জমিতে সার হিসেবে ব্যবহার করা যায় ।
ছোবড়া বা আঁশ :
নারিকেলের ছোবড়ায় আঁশ থাকে। এই আঁশের কদর কোনো অংশে কম নয় । সাধারণ পানিতে ৮-১০ মাস ছোবড়া পচানোর পর ছোবড়া থেকে আঁশ আলাদা হয়ে যায়। এরপর ধৌত করে এবং মুগুর পিটিয়ে আঁশ বের করা হয়। পরিপক্ক ফলের আঁশ অপেক্ষা অপরিপক্ব ফলের আঁশ গুণে উৎকৃষ্ট। আঁশ দিয়ে রশি, পাপোষ, গালিচা, ব্রাশ, গদি, জাজিম ইত্যাদি তৈরি করা হয়। এদেশে নারিকেলের আঁশের রশি, কাতা (Coir) অত্যন্ত পরিচিত। এক হাজার নারিকেলের ছোবড়া থেকে ৭৫-১০০ কেজি আঁশ পাওয়া যায়।
নির্মাণ সামগ্রী :
গাছের কাণ্ড, গৃহনির্মাণ সামগ্রী ও নৌকা নির্মাণে ব্যবহৃত হয়। নারিকেলের মালা থেকে হুক্কা, গয়না, চামচ, পেয়ালা তৈরি হয়। পাতা দ্বারা মাদুর তৈরি, ঘর ছাউনি, ঝুড়ি বানানো যায়। পাতার মধ্য শিরা বা শলা দ্বারা ঝাঁটা তৈরি করা হয়। অকেজো কাণ্ড, পাতা, মালা, ফুলের ছড়া জ্বালানির কাজে ব্যবহার হয়।
কাঠ কয়লা :
নারিকেলের খোল বিশেষ প্রক্রিয়ায় পুড়িয়ে যে কয়লা তৈরি করা হয় তা গবেষণাগারে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়। এই কাঠ কয়লা ময়লা শোষণ করে। এজন্য তেল ও গবেষণাগারে ইহা ব্যবহার হয়।
আরও দেখুন :