আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় ডাল রান্না করার সাধারণ নিয়মাবলি। মাছ-মাংসের পরিপুরক হিসেবে ডাল অনন্য। এ কারণেই ডাল আমাদের খাদ্য তালিকায় আমিষ সমৃদ্ধ এবং মাংসপেশি বর্ধক একটি সুলভ খাবার। ডাল ছাড়া যেন আমাদের খাবার সম্পূর্ণ হয় না এবং তৃপ্তিও পাওয়া যায় না। ফলে খাবারের টেবিলে মাছ-মাংস আর যাই থাক না কেন ডাল অবশ্যই থাকবে।
Table of Contents
ডাল রান্না করার সাধারণ নিয়মাবলি
পূর্বে মাছ-মাংসের পরিবর্তে ভাল খেয়ে আমিষের চাহিদা মেটানো যেত। বর্তমানে ডালের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় এটি আর পরিবের খাবার নেই। রকমারি ডাল রান্নায় বাঙালির জুড়ি নেই। মুগ, মসুর, ছোলা, মটর, মাষকলাই অড়হর মোটামুটি এই ডালগুলো বাঙালির রান্নাঘরে বেশি থাকে। তুলনামূলক বিচারে সব ডালের মধ্যে মসুর ডালে আমিব জাতীয় উপাদান (২৫.১ গ্রাম) বেশি থাকায় এটি সকলের প্রিয় ভাল।
ডাল রান্না করার সাধারণ নিয়মাবলি :
(১) সব ভালে এক রকম ভিটামিন থাকে না। তাই প্রতিদিন একরকম ডাল রান্না না করে একাধিক ডাল রান্না করে খাওয়া উচিত। আর যদি ডালের সাথে কিছু সবজি যোগ করা যায় তাহলে এর আমিষের গুণাগুণ আরও বেড়ে যায়।
(২) ভাঙা মসুর ডালের চেয়ে আস্ত গোটা মসুর ডাল উত্তম। কেননা আস্ত মসুর ডালে পুষ্টিমান পুরোপুরি বজায় রাকে।
(৩) পুরাতন ডালের চেয়ে নতূন ডাল সবচেয়ে ভালো। এটি খেতেও যেমন স্বাদ লাগে তেমনি গুনাগুণ
ও অটুট থাকে এবং সহজেই সিদ্ধ হয়।
(৪) ডাল খেয়ে যারা হজম করতে পারে না তারা ডালের সঙ্গে আলু মিশিয়ে সিদ্ধ করে খেলে হজমে
অসুবিধাটা হবে না ।
(৫) ডাবলি বা চটপটির ডাল বা মটর ডাল নরম করে সিদ্ধ করতে চাইলে সারা রাত ভিজিয়ে রাখতে হবে। তারপর রান্নার সময় সঠিক পরিমাণে খাবার সোডা দিয়ে সিদ্ধ করতে হবে।
(৬) কলাই-এর ডাল সব সময় ধাতব পাত্রে ভিজিয়ে রাখলে ভালোভাবে রান্না হয়ে যাবে।
(৭) ডাল রান্নার সময় খেয়াল রাখতে হবে যাতে ভাল ও পানি আলাদা আলাদা না থাকে। ডাল ও পানি যত মিশবে ততই খেতে সুস্বাদু হবে।
(৮) যদি ডাল একটু পরিষ্কার ও স্বচ্ছ করতে চান তাহলে রান্না করার সময় সামান্য খাবার সোডা মিশিয়ে দিলেই চলবে।
চিত্র : বিভিন্ন প্রকার ডালের ছবি
ডাল সিদ্ধ করার পদ্ধতি :
ডাল রান্না করার পূর্বে ডাল সিদ্ধ করতে কিছু নিয়ম-কানুন জেনে নেয়া উচিত। অড়হর ডাল, মটর ডাল এবং ছোলার ডালের একটি ধর্ম হচ্ছে এগুলো সিদ্ধ হতে চায় না, অনেক সময় লাগে। ডাল সিদ্ধ প্রক্রিয়া নিচের বিষয়ের উপর নির্ভরশীল-
(ক) ডালের প্রকারভেদ : ডালের প্রকারভেদের উপর নির্ভর করে রান্না করার পূর্বে ডাল ২-৪ ঘণ্টা পর্যন্ত পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। তাছাড়া পানিতে ১-৫ ঘণ্টা পর্যন্ত ভিজিয়ে চুলায় হালকা আঁচে রাখলে ভালোভাবে সিদ্ধ হয়।
(খ) পানির খরতা : খর পানির চেয়ে মৃদু পানিতে ডাল সিদ্ধ হতে কম সময় লাগে। খর পানির ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেশিয়ামের ক্লোরাইড ও সালফেট ডাল সিদ্ধ হতে বাধা দেয়।
(গ) খাবার সোডার ব্যবহার : অনেক সময় ডাল তাড়াতাড়ি সিদ্ধ করার জন্য খাবার সোডার (সোডিয়াম বাই কার্বনেট) পাউডার পরিমাণমতো ব্যবহার করে ডাল সিদ্ধ করা হয়। তবে খাবার সোডা ব্যবহার করলে ডালের বি ভিটামিন নষ্ট থেকে পারে।
(ঘ) চাল ধোয়া পানি : সিদ্ধ করার সময় ফুটন্ত ডালে কয়েকটি চাল ছেড়ে দিলে বা চাল ধোয়া পরিষ্কার পানিতে ডাল ঢেলে দিলে সহজেই ডাল সিদ্ধ হয়ে যাবে।
(ঙ) নারিকেল তেল ব্যবহার : ডাল সিদ্ধ করার সময় কয়েক ফোঁটা নারিকেল তেল ব্যবহার করলে ডাল সহজেই সিদ্ধ, নরম ও মোলায়েম হয়ে যায়।
মসুর ডাল রান্নার নিয়ম :
প্রথমে ডাল কিছুক্ষণ পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। তারপর ভিজানো ডাল ভালো করে ধুয়ে পরিমাণমতো পানিতে সিদ্ধ করতে হয়। আধা সিদ্ধ হয়ে এলে এ ডালে হালকা হলুদ, লবন ও সামান্য জিরা বাটা দিতে হয়। ডাল যখন ভালোভাবে সিদ্ধ হয়ে যাবে তখন ডাল ঘুটনি দিয়ে ডাল ভালোভাবে ঘুঁটতে হয়। ডাল যখন পানির সাথে মিশে যাবে তখনই বাগাড় দিতে হবে।
নামানোর পূর্বে ডালে কিছু ধনে পাতা, কাঁচামরিচ দিয়ে নামিয়ে রাখতে হবে। মসুর ডাল একটু ভিন্ন আমেজের টক করতে চাইলে কচি আম সহযোগ রান্না করলে খেতে চমৎকার লাগে। তাছাড়া, টমেটো, মেথি শাকের পাতা, লাউ, তেঁতুল, কুল, আমশুট, জলপাই, পুঁইশাক, ডাঁটা সজনে প্রভৃতি দিয়ে মসুর ডাল রান্না করলেও সুস্বাদুও সুগন্ধযুক্ত হয়ে ওঠে।
মুগ ডাল রান্নার নিয়ম :
মুগ ডালের মধ্যে ‘সোনা মুগ’ সবচেয়ে ভালো। ‘হালি মুগ’ নামে সবুজ রঙের মুগ ডাল অসুস্থ লোকের জন্য খাবার উপযোগী। মনে রাখতে হবে রান্নার পূর্বে মুগ ডাল ভেজে নেয়ার মাঝেই এর স্বাদ লুকিয়ে থাকে। কাজেই এর আসল স্বাদ পেতে চাইলে ডালকে ঘি বা ডালডা দিয়ে ভেজে নিতে হবে।
নিম্নে ডাল রান্নার পদ্ধতি দেয়া হলো-
প্রথমে ভাজা মুগডাল সিদ্ধ করতে হবে। এরপর আলাদা কড়াইয়ে ১ চা চামচ ঘি দিয়ে পেঁয়াজ ও রসুন কুচি বাদামি করে ভেজে তুলতে হবে। এবার আরও কিছু ঘি ভালোভাবে গরম করে তাতে পাঁচফোড়ন ঢেলে বড় চামচ দিয়ে ডাল ঘুঁটে ফেলতে হবে।
ডাল ফুটে উঠলে সবশেষে কিছু গরম মশলার গুঁড়া, কাঁচামরিচ, ক্ষীর অথবা মাখন গরম করে ঐ ডালের উপর ছড়িয়ে দিয়ে নামিয়ে এনে গরম গরম পরিবেশন করা হয়। তাছাড়া এ ডাল রান্নার সময় বাঁটা নারিকেল অথবা পালংশাক দিয়ে ঘি বাগাড় দিলে অভিনব স্বাদে সুস্বাদু হয়ে উঠবে।
মাষকলাই ডাল রান্নার নিয়ম :
(১) রান্নার জন্য মৌসুমের নতুন ডাল সংগ্রহ করতে হবে। পুরাতন ডাল কীটনাশক দিয়ে সংরক্ষণ করা হয় বলে স্বাদ হয় না ।
(২) আমাদের দেশে দুই ধরনের মাষকলাই পাওয়া যায়। একটি কালো কুচকুচে অন্যটি খয়েরি রঙের। কাল মাষকলাই খেতে স্বাদ বেশি।
(৩) মাষকলাই-এর ডাল রান্নার পর যত ঘন হবে তত সুস্বাদু হবে। এ জন্য মাষকলাই রান্নার সময়
ভাতের মাড় বা চালের গুঁড়া মিশিয়ে দিলে ডাল ঘন হয়।
(৪) মাষকলাইয়ের ডাল আরও সুস্বাদু করার জন্য এর সাথে শিং বা টাকি মাছ দিয়ে রান্না করতে হবে।
(৫) মাষকলাই এর ডাল প্রথমে বাদামি করে ভেজে পরে তা গুঁড়া করে রান্না করলে এর ঘ্রাণ অনেক বেড়ে যায় ।
(৬) শহরের ডাল অনেক দিনের পুরোনো এবং তা কলে ভাঙা হয় এতে এ ডালের স্বাদ গুণ ও গন্ধ নষ্ট হয়ে যায়। গ্রামের মৌসুমি ডাল ঢেঁকিতে বা যাঁতায় ভাঙা হয় বিধায় এর নিজস্ব স্বকীয় স্বাদ, গন্ধ ও ভিটামিন অক্ষুণ্ণ থাকে । ফলে ডাল খেয়ে তৃপ্তি পাওয়া যায় ।
আরও দেখুন :